খালেদা জিয়ার বিষয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে রেড়াচ্ছেন যা সত্যিকার অর্থে উদ্ভট। আর এই উদ্ভট ভাষ্যকাররা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন তারা আইনশাস্ত্রে কৌটিল্যসম। তাদের কথাগুলো যে আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য তা জানানোই আমার এ লিখনীর একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি কোনা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি লিখছি না; বরং আইনের কথাগুলো নির্ভুলভাবে ব্যক্ত করার জন্যই আমার এ প্রয়াস। বিএনপির মহাসচিব এবং অন্য নেতৃবৃন্দ, যারা আইনজ্ঞ নন, তারা আইনের কথা জানবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের উচিত নয় আইনের করিৎকর্মা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা। এতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাই ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
তবে আমি অবাক এবং হতভম্ব হয়েছি যখন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের মতো একজন প্রজ্ঞাসম্পন্ন আইনজ্ঞ একটি উল্টোমুখী কথা বললেন। টেলিভিশনে দেখানো খবর মতে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিয়ে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করছে। তার মতো একজন ব্যারিস্টার এমন অসাংবিধানিক কথা বলতে পারেন এটা দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি।
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় বেজায় তফাত রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে আমাদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। কিন্তু তারপরও তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধে আমার কোনো ঘাটতি নেই। আমি তাকে জমির ভাই বলে ডাকি বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত ব্যারিস্টার সরকার আমার অগ্রজ ব্যারিস্টার ওমর ফারুকের (সামন্তবাদের পরিচয় বহনকারী ‘চৌধুরী’ নামটি তিনি আইনানুগভাবেই বর্জন করেছেন) সহপাঠী সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকে। যদিও আমার অগ্রজ ব্যারিস্টার ওমর ফারুক আজীবন বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন, পরবর্তীতে বিচারপতি মেজবাউদ্দিন, সুলতান শরিফ, কে এম সাইফুদ্দিন, সিলেটের ডক্টর চঞ্চল, ড. হায়দার প্রমুখের সঙ্গে শহীদ শেখ ফজলুল হক মণির যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং পরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তার সঙ্গে ব্যারিস্টার সরকারের সখ্য রয়েছে। তবে সখ্যের সূচনালগ্নে ব্যারিস্টার সরকার বিএনপি করতেন না। বিএনপির তখন জন্মও হয়নি। এ ছাড়া ব্যারিস্টার সরকারের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের আরও কারণ হলো এই যে, তিনি ব্যারিস্টার হিসেবে আমার অনেক জ্যেষ্ঠ। আমি যখন আইন অধ্যয়নের জন্য লন্ডনে পাড়ি জমাই, জমির ভাই তখন ব্যারিস্টার হিসেবে পেশারত, আর আমি যখন ব্যারিস্টার হিসেবে বের হই, জমির ভাই তখন মোটামুটি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার। রাজনৈতিক পার্থক্য সত্ত্বেও তিনিও আমাকে স্নেহের দৃষ্টিতেই দেখেন। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করেন ওমর (আমার বড় ভাই) কেমন আছেন। আর এসব কারণেই তার সম্পর্কে বিরূপ কিছু লিখতে কলম চলছিল না। কিন্তু তারপরও ভাবলাম একজন আইনজ্ঞ হিসেবে পাঠকদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে বর্তায় বটে।
আমাদের সংবিধান এবং সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞান রয়েছে, তিনিও যদি সত্যকে ক্রুশবিদ্ধ না করতে চান, তাহলে নিশ্চয় আমার সঙ্গে এক স্বরে বলবেন যে আমাদের সংবিধানে নিশ্চয়ই এমন কোনো কথা নেই যে কোনো সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে খালাস করতে হবে বা জামিনে মুক্তি দিতে হবে। সংবিধানের ৩১ অধ্যায় এবং ৩২ অধ্যায় বরং উল্টোটিই বলছে। ৩১ অধ্যায় মতে, আইন ব্যতীত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে তার জীবন, স্বাধীনতা, দেহ সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। যার সোজা অর্থ এই যে আইনানুগভাবে, অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে স্বাধীনতা এবং এমনকি জীবন থেকেও বঞ্চিত করা যেতে পারে। এ অধ্যায়েও একই ধরনের কথা রয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনগুলো এবং ফৌজদারি আইন বিজ্ঞান বা ক্রিমিনলজি বরং যা বলে তা হলো এই যে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে কারাভোগই করতে হবে। শাস্তির বিধানাবলিও গড়ে উঠেছে এ নীতির ভিত্তিতেই। আমি অবশ্য বলছি না বা এই মর্মে ইঙ্গিতও করছি না যে, জমির ভাই সাংবিধানিক আইনে অপরিপক্ব। এ ধরনের কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আর আমি তা বললেও সেটি হবে সত্যের অসহনীয় অপলাপ। তার পেশা জীবনের বেশি সময়ই জমির ভাই কাটিয়েছেন রিট অধিক্ষেত্রে। তিনি আমার আদালতেও বহুবার আইনজীবী হিসেবে গভীর জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে সাংবিধানিক আইনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। তিনি পাবলিক আন্তর্জাতিক আইনের ওপরে যে গ্রন্থটি লিখেছেন সেটিকে আমি ইয়ান ব্রাউনলি, ওপেন হাইম বা সোয়ারজেন বার্গারের বইয়ের সঙ্গে তুলনা করব না বটে, তবে বইটি যে মানসম্পন্ন তা বলতেই হবে। তদুপরি জমির ভাই বেশ কয়েক বছর জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন। তিনি বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন, তাও বলা যায় না। কয়েক মাস আগে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো তখন তাকে দেহ এবং মন উভয় দিক থেকে পুরোপুরি সুস্থ মনে হয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে সাংবিধানিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়েও জমির ভাই কীভাবে এ ধরনের একটি অসাংবিধানিক কথা বললেন। বহু চিন্তার পর একটি জবাবই পেলাম আর সেটি হলো, এই যে অন্যদের মতো তিনিও একটি সস্তা রাজনৈতিক চমক সৃষ্টির জন্যই এমনটি বলেছেন।
এখন আইনের কথায় আসি। যারা সজ্ঞানে বা আইন না জেনেও বিজ্ঞ আইনজ্ঞের মতো কথা বলে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা কিন্তু জনগণকে এ কথাটি বলছেন না যে, খালেদা জিয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনে অবরুদ্ধ কোনো রাজবন্দী নন, এমনকি তিনি বিচারাধীন আসামিও নন, তিনি যথোপযুক্ত আদালত কর্তৃক সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি। বিচারিক আদালতে দেওয়া দন্ড আপিলেও নিশ্চিত হয়েছে। বিচার হয়েছে দেশের সাধারণ আইনে। প্রশ্ন, সরকার কি তাকে খালাস দিতে পারে?
রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা : পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের সংবিধানেও মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে একটি প্রিরোগেটিভ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে কোনো দন্ডপ্রাপ্ত কয়েদিকে কারাগার থেকে মুক্ত করার। কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এক বন্ধুকে মুক্তি দিয়েছেন। তবে মহামান্য এ ক্ষমতা বলে কাউকে দন্ড মুক্ত করতে পারেন না, শুধু সাজা থেকে মুক্তি দিতে পারেন, অর্থাৎ জেল জরিমানা মওকুফ করতে পারেন মাত্র এবং তাও তিনি করতে পারেন যদি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষমা প্রার্থনা করে সাজা মুক্তি কামনা করে। এভাবে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তির দন্ড কিন্তু মুছে যায় না। একইভাবে খালেদা জিয়া অনুকম্পা ভিক্ষা করে মহামান্যের কাছে আবেদন করলে মহামান্য তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে খালেদা জিয়াকে জেল থেকে খালাস দিতে পারেন, যদিও দন্ড থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন না।
জামিন ইস্যু : খালেদার জামিন নিয়েও অনেকে অনেক অবান্তর কথা বলে বেড়াচ্ছেন, যা অনেক সময়ই হাস্যকরও বটে। কয়েকদিন আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম একজন বিজ্ঞ পন্ডিতের মতো বলে ফেললেন, যে আইনে খালেদার সাজা হয়েছে সে আইন জামিনযোগ্য হওয়ায় খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার দাবিদার। তার এই অবিজ্ঞোচিত উক্তির জন্য মির্জা ফখরুলকে আইনে মূর্খ বলে লজ্জা দিতে চাই না। শুধু এটুকুই বলব, কোনো ব্যক্তি অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে কোনো কথা বললে মূর্খতার অপবাদ তাকে পেতেই হবে। কিছু বলার আগে আলোচ্য বিষয়টির ওপর বক্তার ন্যূনতম জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। মির্জা ফখরুলকে যদি এ ব্যাপারে কেউ পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি এ কথাটি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন যে, জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য তত্ত্বগুলো বিচারাধীন আসামিদের বেলায়ই প্রযোজ্য, দ-প্রাপ্ত কয়েদিদের বেলায় নয়। তাছাড়া যে আইনে তার সাজা হয়েছে সে আইন মোটেও জামিনযোগ্য নয়।
দণ্ডপ্রাপ্তদের জামিন : আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে দন্ডপ্রাপ্তদেরও জামিনের বিধান রয়েছে। তবে এক বছরের অধিক সময়ের সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শুধু আপিল আদালতই জামিন দিতে পারে, বিচারিক আদালত নয়। আর আপিল আদালত জামিনের আবেদন তাকেই বিবেচনা করতে পারে যদি সে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আপিল আবেদন বিচারাধীন থাকে।
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা প্রয়োজন। দায়রা আদালত বা দায়রা ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত কাউকে সাজা প্রদান করলে সে ব্যক্তির একটি স্বয়ংক্রিয় অধিকার থাকে হাই কোর্টে আপিল করার অর্থাৎ সে ব্যক্তি সরাসরি হাই কোর্টে আপিল করতে পারেন, কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। সেই আপিলের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু হাই কোর্ট থেকে আপিল বিভাগে আপিল করার ব্যাপারে সব ক্ষেত্রেই কিন্তু স্বয়ংক্রিয় আপিলের অধিকার থাকে না। আপিল বিভাগে আপিলের বিধান সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ফৌজদারি কার্যবিধি দ্বারা নয়। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ মতে, হাই কোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু তিনটি ক্ষেত্রেই আপিল করা যায়, যার একটি হলো হাই কোর্ট যদি কাউকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে, দ্বিতীয়টি হলো হাই কোর্ট যদি আদালত অবমাননার দায়ে কাউকে সাজা দেয়, আর তৃতীয়টি হলো যদি হাই কোর্ট এই মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করে যে সংশ্লিষ্ট মামলায় সাংবিধানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যাপারে এ তিনটির কোনোটিই প্রযোজ্য নয় বলে আপিল বিভাগে তার স্বয়ংক্রিয় আপিলের অধিকার নেই, অর্থাৎ তিনি তবেই আপিল করতে পারবেন যদি আপিল বিভাগ তাকে আপিল করার জন্য লিভ বা অনুমতি প্রদান করেন। সেই অর্থে এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার কোনো আপিলই আপিল বিভাগে বিচারাধীন নেই। যা আছে তা হলো আপিল করার জন্য লিভ বা অনুমতির দরখাস্ত। এ দরখাস্তের ওপর পূর্ণাঙ্গ শুনানির পরই আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নেবেন তারা আপিলের জন্য লিভ বা অনুমতি প্রদান করবেন কিনা এবং খালেদা জিয়া তবেই আপিলের অধিকার পাবেন যদি আপিল বিভাগ লিভ বা অনুমতি প্রদান করেন।
আপিল বিভাগ শুধু সেক্ষেত্রেই তার জামিনের দরখাস্ত বিবেচনা করতে পারবেন যদি উক্ত বিভাগ তাকে আপিলের অনুমতি প্রদান করে, যে অনুমতি এ মুহূর্ত পর্যন্ত নেই। আপিল বিভাগ ‘লিভ টু আপিল’ প্রদান না করলে খালেদা জিয়া কখনো এ সাজাপ্রাপ্ত আদেশের ব্যাপারে আপিল বিভাগে জামিনের দরখাস্ত করতে পারবেন না। সব নির্ভর করছে আপিল বিভাগ ‘লিভ টু আপিল’ দেবেন কিনা তার ওপর। সুতরাং দ-প্রাপ্ত মামলায় জামিনের ব্যাপারে বাজার গরম করার চেষ্টায় যারা লিপ্ত, তারা জেনে হোক বা না জেনেই হোক, জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই এটি করছেন।
প্যারোলে মুক্তি : প্যারোলে মুক্তির বিধানটি পৃথিবীর বহু দেশেই বিদ্যমান। এটি কোনো বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ডিসক্রেশনের ব্যাপার। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত প্যারোলের আইন মতে কোনো বিশেষ কারণে, যথা কোনো নিকটজনের মৃত্যুর কারণে, সরকার তার ডিসক্রেশনমাফিক কোনো কয়েদিকে সাময়িক মুক্তি দিতে পারেন, যা নেহায়েতই স্বল্পকালের জন্য, অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়। তাও কয়েদির দরখাস্ত সাপেক্ষে।
চিকিৎসা : চিকিৎসার অধিকারকে আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের তালিকায় প্রত্যক্ষভাবে সন্নিবেশ করা হয়নি বটে কিন্তু, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র তালিকায় ১৫(ক) অনুচ্ছেদে চিকিৎসাসহ জীবনধারার মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত মানবাধিকার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হওয়ায় সেই ঘোষণাতে উল্লিখিত অধিকারগুলোও আমরা আন্তর্জাতিক আইনের বিধানমতে মানতে বাধ্য।
সুতরাং সব মানুষের জন্য চিকিৎসার নিশ্চয়তা নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বলা বাহুল্য, এ দায়িত্ব বিচারাধীন আসামি এবং দ-প্রাপ্ত কয়েদিদের প্রতিও রয়েছে, যার কথা বিস্তারিতভাবে জেল কোডে বলা আছে। তবে একজন কয়েদির কোনো অধিকার নেই সিঙ্গাপুর-লন্ডন গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার বা তার পছন্দ মতো কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার।
চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রতিটি কারাগারেই চিকিৎসা ইউনিট রয়েছে। যদি কোনো রোগীর চিকিৎসা কারাগারের চিকিৎসা কেন্দ্রে অপ্রতুল হয় তাহলে সেখানে বিশেষজ্ঞ আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে- এর বেশি নয়। তার পরেও আমাদের দেশের সর্বোচ্চ এবং সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে রয়েছে বহু বিশ্বমানের চিকিৎসক, খালেদা জিয়াকে একাধিকবার নেওয়া হয়েছে, চিকিৎসকরা বোর্ড বসিয়ে তার রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করেছেন। এটি ছিল তার অধিকারের চেয়ে অনেক বেশি। দেশে হাজার হাজার অসুস্থ কয়েদির কেউই এ ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পায়নি। সংবিধান বলছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হিসেবে তিনি অন্য কয়েদিদের চেয়ে বেশি কিছু দাবি করতে পারেন না। অন্য সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের যে ইফতার দেওয়া হয়, তার বেশি ইফতার খালেদা পেতে পারেন না।
এতকিছুর পরেও কিছু লোক সস্তা রাজনৈতিক চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলে বেড়াচ্ছে খালেদাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। খালেদাকে যে ধরনের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে সে ধরনের চিকিৎসা সুবিধা বিত্তশালী বহু মুক্ত মানুষও পাচ্ছেন না, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত বোর্ডের চিকিৎসা নেওয়ার সৌভাগ্য কজনের হয়? যারা এসব সস্তা গলাবাজি করে বেড়াচ্ছেন তাদের কিন্তু বোঝার সময় হয়েছে যে, দেশের মানুষ তাদের এসব মিথ্যাচারে আর পা দিচ্ছেন না আর তার জন্যই জনমনে কোনো প্রভাব এ অপপ্রচারকারীরা ফেলতে পারছেন না। তাদের অবস্থা আজ লর্ড হো হোর মতো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে ব্যক্তিকে বার্লিন বেতারের মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণার জন্য ঘৃণা এবং কৌতুকভরে ডাকা হতো ‘লর্ড হো হো’ বলে।
লেখক : সাবেক বিচারপতি।