জাতিসঙ্ঘে শ্বেতপত্র দেবে বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’, ‘ব্যালট ছিনতাই’সহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্যসংবলিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে বিএনপি। এ নিয়ে কাজ করছে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি টিম। লিখিত তথ্য সংগ্রহের পর তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ধানের শীষের দুই-তৃতীয়াংশ প্রার্থী তাদের নির্বাচনী আসনে বিভিন্ন অনিয়ম সংবলিত প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

সব প্রার্থীর প্রতিবেদন জমা হলে তার ওপর ভিত্তি করে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। এ ছাড়া যেসব প্রার্থী ভিডিওচিত্র জমা দিচ্ছেন সেগুলো একত্রিত করে একটি সমন্বিত তথ্যচিত্র তৈরি করা হবে। এরপর প্রতিবেদনের কপি নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাস, কূটনৈতিক মিশন ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কাছে দেয়া হবে। সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবেদন গণমাধ্যমে তুলে ধরা ছাড়াও দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলোকে জানানো হবে। পাশাপাশি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য দেবেন দলটির নেতারা। বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতাদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নোয়াখালী-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুুপি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করব আমরা। এ বিষয়ে কাজ করছি। তিনি বলেন, নির্বাচন যেটা হয়ে গেল, সেই নির্বাচনের বিবরণী আমরা দিতে চাই এবং দেবো আমরা। এর ওপরে আমরা তথ্যভিত্তিক একটি শ্বেতপত্র বের করব। তাতে মানুষ দেখবে- জনগণ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছে, ৫ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে পেরেছে। প্রশাসন-পুলিশ নির্বাচন করেছে, সেখানে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

জানা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয় ধানের শীষের প্রার্থীদের। চিঠিতে প্রত্যেক প্রার্থীকে আটটি ক্যাটাগরিতে নির্বাচনে অনিয়মের তথ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবর জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ক্যাটাগরি অনুযায়ী প্রার্থীদের নিজের ও পরিবারের অবরুদ্ধ হয়ে পড়া কিংবা হামলায় আহত, সহায় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য ও ছবি, নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় সংঘটিত অনিয়ম, ভোট জালিয়াতি, সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের তাণ্ডব এবং সন্ত্রাসের সচিত্র প্রতিবেদন ইত্যাদি চাওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রার্থী তাদের নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির তথ্যসংবলিত লিখিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আমরা প্রত্যাশা করছি খুব স্বল্প সময়ের ভেতরেই সব প্রার্থী রিপোর্ট জমা দেবেন। এসব রিপোর্ট কী করা হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এসব রিপোর্ট বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা করে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করবো। যা রেকর্ড হিসেবে থাকবে।

এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি গায়েবি মামলা ও হামলা-নির্যাতনের শিকার দলের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে দলের কারাবন্দী নেতাকর্মীদের আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে গত মাসের মাঝামাঝি নাগাদ দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম-মহাসচিবদের প্রধান করে গঠিত ১০টি সাংগঠনিক বিভাগীয় কমিটি ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। অনেকে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা সফর করে এসেছেন, আবার অনেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এর আগে টিম লিডাররা প্রাথমিকভাবে বিভাগের সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং অধীনস্থ জেলার নেতাদের নিয়ে জেলার ক্ষয়ক্ষতি ও মামলার বিষয়ে কথা বলছেন। তারপর তারা জেলা সফরে যাচ্ছেন। সফরে গিয়ে টিম লিডাররা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ধানের শীষের প্রার্থীদের সাথে কথা বলছেন। নেতাকর্মীর জামিনে মুক্তি লাভে প্রধান অন্তরায়গুলো কী তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের কতটুকু আইনি সহায়তা দেয়া হচ্ছে, সেটিও চিহ্নিত করছেন।

এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের সাহায্যার্থে প্রার্থীরা কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি-না কিংবা নিতে না পারলে সমস্যা কোথায়-চিহ্নিত করছেন। সফরে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের দলের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তাও দেয়া হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে তৃণমূল সফর শেষ করে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি নিজ নিজ প্রতিবেদন দলের হাইকমান্ডের কাছে জমা দেবেন টিম লিডাররা। তারপর দলের নীতিনির্ধারকেরা সেসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই ব্যাপারে আশু করণীয় নির্ধারণ করবেন।

জানতে চাইলে রংপুর বিভাগে সাংগঠনিক প্রধান ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, গত মঙ্গলবার রংপুরে গিয়ে প্রার্থীদের সাথে কথা বলে খোঁজখবর নিয়েছি। কতজন জেলখানায় আছে, কতজন মামলার আসামি তাদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে এসেছি। হতাহতদের পরিবারকে দলের পক্ষ থেকে সহায়তা দেয়ার কথাও বলেছি। আমি নিজেও আহত পরিবারের লোকজনকে সহযোগিতা দিয়েছি।

গত মঙ্গলবার দুপুরে নেত্রকোনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের খবর নিতে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে নেত্রকোনা জেলা বিএনপি। এতে ময়মনসিংহ সাংগঠনিক বিভাগের প্রধান ও দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন। নেত্রকোনা-২ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: আনোয়ারুল হকের বাসভবনে এই সভা হয়। এতে নেত্রকোনা জেলার অন্যান্য আসনের ধানের শীষের প্রার্থী ছাড়াও বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল বারী ড্যানী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।–নয়াদিগন্ত