অবশেষে জামায়াত ছাড়ছে বিএনপি

দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতকে ছাড়ছে বিএনপি। আগামী উপজেলা নির্বাচনেই দুদলের পথ দুদিকে বেঁকে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে বিএনপি জামায়াতের কোনো কর্মকাণ্ডের দায় নেবে না। দলটির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, বিএনপি মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দল। এর প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। শুরু থেকেই দলটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য ছিল। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও দলটি সাহসী ভূমিকা পালন করে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে তারা। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০০ সালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। এরপর একটানা ১৯ বছর সেই জোট অটুট থাকে। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিবন্ধন হারানো জামায়াতের প্রার্থীদের ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়ার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই বিএনপির একাংশের বিরোধিতা ছিল। বিশেষ করে তরুণ নেতৃত্ব জামায়াত-সখ্য কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। কেননা আশি ও নব্বই দশকে ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী তাণ্ডবের শিকার হয়েছিলেন।

তবে দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের কারণে প্রকাশ্যে তারা নিজেদের অসন্তোষ ও বিরোধিতা করতে পারেননি। দিনে দিনে এ বিষয়ে তাদের ক্ষোভ বেড়েছে। তারা মনে করছেন, জামায়াতকে জোটসঙ্গী বানিয়ে অনেকটা ‘খাল কেটে কুমির আনার মতো’ ডেকে বিপদ এনেছে বিএনপি। কেননা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও শিবিরের বিতর্কিত ভূমিকা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ সব অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে বিএনপিকে। মূল্যও দিতে হচ্ছে অপরিসীম।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে ভরাডুবি হয়েছে তাদের। বলা যায়, সাংগঠনিকভাবে বিএনপি দাঁড়াতেই পারেনি। ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নির্বাচন করলেও মাত্র ৮টি আসনে তাদের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। ‘ভোট জালিয়াতি’র অভিযোগ তুললেও নির্বাচনের পর তারা গত একমাসে সংবাদ সম্মেলন ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি হাজির করতে পারেনি। নির্বাচনের বিপর্যয়কর ফলাফল ও সেটাকে ঘিরে কোনো শক্ত কর্মসূচি দিতে না পারায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। তারা এই বিপর্যয়ের পেছনে জামায়াতকে নিয়ে দলের হাইকমান্ডের ভুল রাজনীতিকে দায়ী করেছেন।

তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বস্তরে বিএনপির নেতাকর্মীরা বর্তমানে মনে করছে জামায়াত এখন বিএনপির বোঝা। তাদের প্রশ্ন এ বোঝাকে কেন তারা বহন করবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই বোঝা দলের ঘাড় থেকে নামানো যাবে ততই মঙ্গল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন নেতা বলেন, জামায়াত বিএনপির কোনো আদর্শিক মিত্র নয়। ভোটের সমীকরণ ও কৌশলগত কারণেই তাদের সঙ্গে জোট করা হয়েছিল। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্তি-সামর্থ্য বর্তমানে জামায়াতের আর নেই।

বরং উল্টো জামায়াতের কারণে দেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে কমেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও মুক্তিযোদ্ধা আধিক্যের দল হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের কারণে ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসর’ তকমা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। বহির্বিশ্বের কাছে বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

তারা বলছেন, নির্বাচনের পর গত একমাসে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে পরাজয়ের বিষয়ে নানা মতামত ও অভিযোগ দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের অসহযোগিতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনপীড়ন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাধা ও হামলার কারণে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। জামায়াতের কারণে সাধারণ জনগণের কাছে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

সামগ্রিক বিবেচনায় বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের বেশির ভাগ বর্তমানে জামায়াত-বিচ্ছেদের পক্ষে। আপাতত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেবে না। তবে জামায়াতের বিষয়ে তারা নিশ্চুপ থাকার নীতিতে থাকবে। জামায়াতকে নিয়ে গড়ে তোলা ২০-দলীয় জোটকেও আপাতত সক্রিয় করবে না।

তারা মনে করছেন, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি তাদের দুই যুগের জোটগত বন্ধন ছিন্ন করবে। দুই আদর্শের দুই দলের পথ দুদিকে চলে যাবে। উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হবে বিএনপি। এরই মধ্যে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণা দিয়েছে দলগত ও জোটবদ্ধভাবে তারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপ বা চা-চক্রেও অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত তারা জানিয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও তৃণমূল নেতারা কোথাও যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় তবে তারা কেন্দ্র থেকে আপত্তি করবে না। তবে উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত আসবে কি আসবে না তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। জামায়াতকে নিজেদের বিষয় নিজেদের সামলাতে হবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের অক্টোবর মাসে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে বিএনপি। নতুন এই জোট রাজনীতিতে আশার আলো দেখালেও বিএনপি তাদের পুরনো মিত্র জামায়াতের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখে। নানামুখী সমালোচনার পরও ধানের শীষে মনোনয়ন দেওয়া হয় জামায়াত প্রার্থীদের।

আর কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জামায়াত ইস্যুতে কৌশলী অবস্থান নেন। কিন্তু এ কৌশল শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ করে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে। প্রতিপক্ষ আওয়ামী জোট যেমন এ ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্টকে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন জোট বলে সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করে, ঠিক আবার জনগণের মধ্যেও এ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। অস্বস্তিকর এসব প্রশ্নে খেইও হারান ড. কামাল হোসেন। সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়ে উল্টো সমালোচনার মধ্যে পড়েন। নির্বাচনের পরে ভারতের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকারও করেন, জামায়াত আসলে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টে যেতেন না।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গড়ে তুলে খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করে দলটির নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে দলটি নিষিদ্ধ হয় এবং চিহ্নিত রাজাকারদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সুযোগে জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রাঙ্গনে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ছাত্র শিবির। নব্বইয়ের প্রথম দিকেও এ ধারা অব্যাহত থাকে।

২০০০ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় দলটি। চিহ্নিত কয়েকজন আলবদর নেতা চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী হন। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে অর্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয় যুদ্ধাপরাধের মাস্টারমাইন্ডের গাড়িতে। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষের মাঝে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, বাংলা ভাইসহ জঙ্গি উত্থান- এসব ঘটনায় জামায়াত নেতাদের সংশ্লিষ্টতা মেলে।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম, কামারুজ্জামানসহ শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদ- হয়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে পেট্রলবোমা ও সন্ত্রাসী হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হন। এ সব হামলার বেশির ভাগের জন্য দায়ী ছিল জামায়াত-শিবির।

জোটসঙ্গী জামায়াতের এসব অপকর্মের দায়ভার না চাইলেও এত দিন বিএনপির ওপর বর্তেছে। তবে ভোটের সমীকরণে পুরো বিপরীত আদর্শের জামায়াতকে সঙ্গী রেখেছিল তারা। কিন্তু তাতে দিনে দিনে ক্ষতির বোঝা বাড়ছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘মিছামিছি’ প্রশ্নের মুখে পড়ছেন তারা। এখন সময় এসেছে জামায়াত-বিচ্ছেদের।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দল। তার নিজস্ব নীতি-আদর্শ আছে। তাই আমি মনে করি, এমন কোনো দলের সঙ্গে বিএনপির জোট করা উচিত নয়, যে দলটির নীতি-আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। বিএনপি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল। এই দল কেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করবে? বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ছিন্ন করা।’

সূত্রঃ খোলা কাগজ

————————-
মজার মজার ভিডিও দেখুন টাচ করে