ভোট কারচুপির সব আয়োজন চূড়ান্ত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১ আসনে (নবাবগঞ্জ-দোহার) প্রভাবশালী প্রার্থীকে জেতাতে ভোট কারচুপির সব আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

ভোট গণনার সময় বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া ছাড়াও পদে পদে নানা ফাঁদ পাতা হয়েছে। এ কাজে অনেকটা জোর করে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের বাধ্য করা হবে। সে রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রিসাইডিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের ব্রিফিং করে নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ ছাড়া এ কাজ যাতে খুব সহজ হয় সে জন্য পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বেছে বেছে দলসমর্থিত লোকজনকে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

তবে ভোট জালিয়াতির এ কাজে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারেন গণমাধ্যম কর্মীরা। সে জন্য সম্প্রতি দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভির সাংবাদিকদের ওপর বর্বরোচিত হামলার পথ বেছে নেয়া হয়। যাতে তারা কোনোভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে না পারেন সে জন্য এখনও নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া অব্যাহত আছে।

তারা আরও জানান, যেহেতু নানা কারণে সবার দৃষ্টি ঢাকা-১ আসনের দিকে তাই প্রশাসনের সহায়তায় এ চক্রের মূল পরিকল্পনা হল- বাইরে থেকে এ আসনের প্রতিটি কেন্দ্রের পরিবেশ শান্ত রাখা। আর ভেতরে ভোট গণনায় জালিয়াতি করে যে কোনো মূল্যে নৌকার প্রার্থীকে পাস করানো। সম্প্রতি রুদ্ধদ্বার একটি মিটিং থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়েছেন কয়েকজন ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা।

তারা বলেন, ভোট জনগণের পবিত্র আমানত। এর মাধ্যমে জনগণ ৫ বছর অন্তর নিজ নিজ সংসদীয় আসনে পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চায় এবং এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়। তাই এই আমানতের খেয়ানত করে জালিয়াতির মাধ্যমে কাউকে জোর করে পাস করানোর মতো জঘন্য কাজটি তারা করতে চান না। এ জন্য তারা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া তাদের বিশেষ উপঢৌকন নিতে রাজি না হওয়ায় তাদেরকে প্রশাসন দিয়ে শাসানো হয়। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছেন এ কাজে স্থানীয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরাসরি জড়িত দেখে।

তারা বলেন, ভোট কারচুপির এই ভয়াবহ ফাঁদ থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। ভোটারদের দল বেঁধে সকালেই ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজের ভোট পাহারা দেয়া। এ ছাড়া গণমাধ্যম কর্মীদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ঢাকা-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মটরগাড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি বিশ্বস্ত বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি, নবাবগঞ্জ-দোহারে সরকারি দলের প্রার্থী ভোট কারচুপির সব আয়োজন চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাব, জনগণের আমানত ভোট নিয়ে কারচুপিতে সহায়তা করার ক্ষমতা আপনাদের কেউ দেয়নি। এটি সংবিধান ও আপনাদের কর্মচারী আইনের পরিপন্থী। সর্বোপরি এটি ফৌজদারি অপরাধ। আমি প্রত্যাশা করব, আপনারা কেউ এমন জঘন্য অন্যায় কাজে সহায়তা দেবেন না।

বরং আপনাদের দায়িত্ব একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করা। কারণ আইন আপনাদের সে ক্ষমতা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তারপরও কেউ যদি এ ধরনের কাজ করতে চায় তাহলে জনগণের কাছে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। দেশের আইন ও জনগণ তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।’

সালমা ইসলাম বলেন, ‘সম্মান দেয়া এবং নেয়ার মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তাই আমি মনে করি মহান সৃষ্টি কর্মকর্তার রহমতে আমার প্রাণপ্রিয় ভোটাররা সাহসের সঙ্গে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন। কারণ আপনি সাহসী হলে আপনিই বাংলাদেশ, না হলে সব শেষ।’ তিনি ৩০ ডিসেম্বর সম্মানিত ভোটারদের সব ধরনের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

একই সঙ্গে সব গণমাধ্যম কর্মী ও সাংবাদিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি ভোট চুরি করতে চাই না, চাই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। তাই আপনারা জনগণের পক্ষে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে দায়িত্ব পালন করবেন, এটিই আমার বিশ্বাস।’

ভোট কারচুপির যত ফাঁদ : ঢাকা-১ আসনের ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসার ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, প্রথমত ভোট গণনার সময় সবচেয়ে বড় কারচুপি করা হবে। যেমন, ব্যালট পেপারের ১০০টি বান্ডিলের নিচে এবং উপরের দিকে ১০-১৫টি করে নৌকার ব্যালট পেপার রেখে দিয়ে ভেতরে সব মটরগাড়ি প্রতীকের ব্যালট ঢুকিয়ে দেয়া হবে।

এরপর গণনাকারী ওই বান্ডিলকে নৌকা প্রতীকের ১০০টি ভোট হিসেবে ঘোষণা দেবেন। এভাবে নৌকা প্রতীকে ৩০ ভাগ ভোট পেয়েও ঘোষণা দেয়া হবে ৭০ ভাগ। অপরদিকে মটরগাড়ি প্রতীকে ৭০ ভাগ ভোট পড়লেও ঘোষণা দেয়া হবে ৩০ ভাগ। আবার জালিয়াতির আর এক ধাপে ভোট গণনার সময় নৌকা প্রতীকের ব্যালট যদি হয় ৭০টি, তা ঘোষণা দেয়ার সময় বলা হবে ১০০টি। বিপরীতে মটরগাড়ি প্রতীকের ব্যালটের সংখ্যা গণনার সময় কম বলা হবে। এ কাজে নৌকার পোলিং এজেন্টদের অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়নে পূর্ণ সহায়তা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এভাবে ভয়াবহ ভোট কারচুপির সময় পুরো নির্বাচনী কেন্দ্রের পরিবেশ শান্ত রাখা হবে। ওই সময় নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারাসহ তাদের পক্ষে থাকবে ১০-১৫ জন বা উপস্থিত প্রায় সবাই। বিপরীতে মটরগাড়ি প্রতীকের পোলিং এজেন্ট ১ জন থাকায় তার পক্ষে ওই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হবে। সূত্র বলছে, তাকে নানাভাবে জিম্মি করে ফেলা হবে। ভোট কারচুপির অভিনব এ সূক্ষ্ম পন্থা অবলম্বন করে সারা দেশ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে দেখানো হবে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সকাল বেলা বড়জোর ২ ঘণ্টা ভালোভাবে ভোট গ্রহণ করার পর পরিকল্পিতভাবে নির্ধারিত বেশকিছু কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি করা হবে। সেখানে লাঠিচার্জ কিংবা ককটেল ফাটানোর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এ সময় ভোটাররা ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে কিছু সময়ের জন্য ভোট গ্রহণ স্থগিত রেখে ভেতরে সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে পরিকল্পনা অনুযায়ী সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হবে। এ দায়িত্ব কারা কীভাবে পালন করবে তা আগে থেকে ঠিক করা থাকবে।

তৃতীয়ত, ভোট জালিয়াতিতে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিতে দলের নির্ধারিত কিছু লোকজনকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে ‘সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক কার্ড’ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে তাদের আগে থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। যাতে তারা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে।

চতুর্থত, ভোটের আগের রাতে কমপক্ষে ৩০ ভাগ ভোট ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার খবর তো বাজারে অনেকে আগেই ছড়িয়েছে। এ ছাড়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্রগুলো আরও জানায়, ‘আমরা শুনছি একেবারে ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার জন্য আগে থেকে বিকল্প ফলাফল শিটে প্রিসাইডিং অফিসারদের স্বাক্ষর জোর করে নিয়ে নেয়া হবে। আবার ভোট গ্রহণ শেষে যদি মনে হয়, কোনো কেন্দ্রে সরকারি দলের প্রার্থী পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা আছে তাহলে কেন্দ্রে ভোট গণনা না করে ব্যালট বাক্স ইউএনও অফিসে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর সেখানে নিয়ে ফল পাল্টে দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে সেই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।

পঞ্চমত, সরকারবিরোধী ভোটারদের আগেভাগে চিহ্নিত করে ভোটদানে বিরত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেটি গত কয়েকদিন থেকে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় নৌকা প্রতীকের ক্যাডার নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে। মটরগাড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের ওপর প্রতিদিন হামলা করা হচ্ছে। শুরু থেকেই নির্বাচনী প্রচারে হামলা করা ছাড়াও নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। এ ছাড়া সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা মটরগাড়ি প্রতীকের সক্রিয় নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাতের বেলা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারসহ হত্যার হুমকিও দিচ্ছেন। গত কয়েকদিন থেকে বলা হচ্ছে, তারা যেন ভোট দিতে না যায়। এ ছাড়া ভোট কারচুপির পথ নির্বিঘ্ন করতে সাংবাদিকদের ওপর জঘন্যতম হামলা করা হয়েছে।

এদিকে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জানা যায়, সরকারি দলের ক্যাডাররা দিনের বেলা মটরগাড়ি প্রতীকের প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। বেশ কয়েকজন এজেন্টকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যেন সে এজেন্টের দায়িত্ব পালন না করে। তাহলে তার জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে। এ অবস্থায় কীভাবে ৩০ ডিসেম্বর অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।–যুগান্তর