সেনা মাঠে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

বহুল প্রত্যাশিত সেনাবাহিনী ভোটের মাঠে নেমে গেছে। সেনা মাঠে নামার পর এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এক দলীয় প্রচারণার খাঁচা ভেঙ্গে নির্বাচনী মাঠে অন্যান্য প্রার্থীরা গতকাল নামলেও কয়েকটি জেলায় হামলার ঘটনায় ধানের শীষ প্রতীকের একাধিক প্রার্থী আহত হন। সেনা নামার পরও রাতের পুলিশী গ্রেফতার চলছে আগের মতোই সমান তালে।

প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না হওয়ায় মানুষের অনিশ্চয়তা আরো বাড়ছে। গতকাল রাজধানী ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে এনিয়ে কথা বললে তারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, মানুষ মনে করছে সেনা মাঠে নামলে পুলিশ প্রচারণার মাঠে পক্ষপাতিত্ব আচরণ করতে সাহসী হবে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের আক্রমন ও উশৃংখল আচরণ কমে যাবে। কিন্তু সেটা এখনো বন্ধ হয়নি। সংঘাত চলছেই; পুলিশের পক্ষপাতিত্ব আচরণ রয়েছে আগের মতোই।

নোয়াখালী, লক্ষিপুর, নরসিংদী, শরীয়তপুর, পাবনা, জামালপুর, মুন্সিগঞ্জ, নড়াইল, চাঁদপুরসহ কয়েকটি জেলায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী-কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত সব প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।

সেনাবাহিনী মাঠে নামার পরও সংঘাত সংঘর্ষ এবং গুলিবর্ষনের ঘটনা ঘটনায় মানুষ স্তম্ভিত। এখনো অনেক এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা নির্বিঘে্ন নামতে পারছে না। তবে মানুষ বলাবলি করছে, সবেমাত্র সেনা সদস্যরা মাঠে নেমেছে। প্রথম দিন তারা বিভিন্ন জনের সঙ্গে বৈঠক এবং এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছে। এ জন্য হয়তো এখনো অপ্রীতিকর ঘটনা বন্ধ হয়নি। মঙ্গলবার থেকে হয়তো অ্যাকশন শুরু হবে। কিন্তু একজন সাবেক সেনাকর্মকর্তা মন্তব্য করেন এই বলে যে, সেনাবাহিনী মাঠে নেমেই প্রথমেই দুষ্টলোকদের বার্তা দেবে যে তারা কাউকে ছাড় দেবেন না। যারা উশৃংখল আচরণ করছে, প্রশাসনের থেকে পক্ষপাতিত্ব করছেন তাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে না পারলে পরিবেশ স্বাভাবিক হবে না।

বিভিন্ন প্রতিনিধিরা জানান, সারাদেশে গ্রাম পর্যায়ে ধানের শীষ প্রতীকের নেতকার্মীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করছে পুলিশ। সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে ভোটারদের মধ্যে ভোটের আস্থা ফিরে আসবে। স্ববিরোধী কথাবার্তা এবং পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে সিইসি সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তবে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে সেনাবাহিনী দেশের সম্পদ। তারা কোনো দলের প্রতিষ্ঠান নয়। অতীতে তারা যেভাবে জনগণের পাশে থেকে নিরপেক্ষ ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এবারও তাই করবেন। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সেনাবাহিনী এই ১০দিন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি সেনাবাহিনী।

নোয়াখালীতে প্রার্থীদের উপর হামলা ফাঁকা গুলি
নোয়াখালী-৫, নোয়াখালী- ১ ও নোয়াখালী-২ আসনে বিএনপি প্রার্থীদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসময় কয়েকটি স্থানে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট) আসনের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নতুন বাজার এলাকায় আসনটির বিএনপি প্রার্থী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের গাড়ী বহরে হামলা চালিয়ে দুইটি গাড়ী ভাঙচুর ও ৫ নেতাকর্মীকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে। দুপুরে এই ঘটনার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, এ ঘটনার পর নির্বাচনী এলাকায় আমার জীবনের নিরাপত্তা নেই। গত রোববার বাটইয়াতে গণসংযোগ করতে পারিনি। আমার প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের আক্রমনের মুখে চলে এসেছি। বিষয়টি নোয়াখালী জেলার সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল মনির সহকারী রির্টানিং অফিসার ও জেলা রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়েছি।

অপরদিকে, দুপুর ১২টার দিকে নোয়াখালী-২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী একাংশ) আসনের সেনবাগ উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়নের সাহাপুর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণাকালে আসনটির বিএনপি প্রার্থী জয়নুল আবেদিন ফারুকের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করে। এসময় ফারুক পাশ^বর্তী একটি বাড়ীতে গিয়ে অবস্থান করে। বিকেলে এই ঘটনার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।

এদিকে, নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের গণসংযোগ চলাকালীন সময়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ব্যারিষ্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন খিলপাড়া থেকে মল্লিকা দিঘীর পাড় যাওয়ার সময় একদল সন্ত্রাসী তার গাড়ী বহরে ধাওয়া করে। এরপর শাহপুর উত্তর বাজার পৌঁছলে সন্ত্রাসীরা তার প্রচার গাড়ীতে হামলা চালায়। গাড়ী ভাংচুর করে। মাহবুব উদ্দিন খোকন উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে বলেন, সাহাপুর বাজারে সন্ত্রাসীরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে পালিয়ে যায়।

লক্ষ্মীপুরে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এ্যানিসহ আহত-৩০
লক্ষ্মীপুর ৩ আসনের বিএনপি নেতা ও ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীর গনসংযোগে হামলায় প্রার্থী শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, তিন সাংবাদিক, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের অন্তত ৩০জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। অন্যদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে পুলিশ।

শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির আত্মীয় ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মোঃ শ্যামল জানান, হামলাকারীদের লাঠি ও ইটের আঘাতে ধানের শীষের প্রার্থী শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ অন্তত ২৫ নেতাকর্মীর আহত হয়।

শরীয়তপুরে হামলা : প্রার্থীসহ আহত ৫০
শরীয়তপুর-৩ (গোসাইরহাট-ডামুড্যা-ভেদরগঞ্জ) আসনের ধানের শীষ প্রতিকের প্রার্থী ও তারেক রহমানের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী মিয়া নুরুদ্দিন অপুর উপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। গোসাইরহাট বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন হেলিপ্যাড নামক স্থানে পৌঁছলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা নুরুদ্দিন অপুর মিছিলে হামলা চালায়। এ সময় মিয়া নুরুদ্দিন অপুসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। নুরুদ্দিন অপুকে এয়ার এম্বুলেন্স যোগে ঢাকায় নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত অন্যান্য নেতাকর্মীদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর গাড়ী ভাংচুর : আহত ১৫
মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং-টঙ্গিবাড়ী উপজেলা) আসনের বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রার্থী সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিন্হা প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়েছেন, এসময় সন্ত্রাসীরা তার দুটি গাড়িও ভাংচুর করে। হামলায় তিনিসহ প্রায় ৯ জন নেতা-কর্মী আহত। পরে এলাকাবাসী ছুটে এলে আক্রমনকারীরা পালিয়ে যায়।

এদিকে, সিরাজদিখানে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম (মুন্সীগঞ্জ-১ আসন প্রার্থী) নির্বাচনি প্রচারণায় গেলে ১৮/২০ মোটর সাইকেল যোগে প্রায় ৩০/৩৫ জন সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ৫টি গাড়ি (মাইক্রো-প্রাইভেট কার) ভাঙচুর করা হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা নেতাকর্মী সহ ৬ জন গাড়ির কাঁচ ভেঙে আহত হয়। এ ব্যাপারে সিরাজদিখান ও টঙ্গীবাড়ি সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান জানান, বেশ কয়েকটি গাড়ীতে ভাংচুরের কথা শুনেছি।

চাঁদপুরে রণক্ষেত্র : আহত ২০
চাঁদপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে। বিএনপি আওয়ামী-লীগের দুই গ্রæপের সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সদর আসনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর বাড়ির প্রধান ফটক। এ ঘটনায় শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিএনপির একটি মিছিল শহরের নতুন বাজার এলাকায় ধানের শীষের প্রাথী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগের নৌকার প্রাথী ডা.দিপু মনির বাড়ির পাশ থেকে দুবৃর্ত্তরা ইটপাটকেল ছুড়লে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায় । ঘন্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে শহরের নতুনবাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিনত হয়। পরে পুলিশ র‌্যাব ও বিজিবি এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে ।
পাবনায় পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ

পাবনার সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দি বাজারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় বাজারের ১০-১২টি দোকান ভাঙচুর করা হয়।

জামালপুরে বিএনপি অফিসে ভাঙচুর : আহত ৫
জামালপুরের সরিষাবাড়িতে উপজেলা বিএনপির অফিসে দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসময় বিএনপির ৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এসময় দুর্বৃত্তরা আশপাশের ১০/১২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নেতাকর্মীদের ৭/৮টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

যশোরে নির্বাচনী অফিস ভাংচুর
যশোর-৪ আসনের এমপি ও নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী রণজিত কুমার রায়ের ছেলে রাজীব রায়ের নেতৃত্বে বাঘারপাড়ার বিভিন্ন গ্রামে অন্য প্রার্থীদের অফিস, বাড়িঘর ভাংচুর, ভয়ভীতি প্রদর্শন করার অভিযোগ করা হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর বাঘারপাড়া উপজেলার বন্দবিলা ইউনিয়নের বড় খুদড়া গ্রামের ওয়ার্কার্স পার্টি কর্মী কাশেম জোয়ার্দারকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে শিবির সাজিয়ে নাশকতা মামলায় চালান দেওয়া হয়েছে। গত ১৬ ডিসেম্বর একই ইউনিয়নের সাদীপুর গ্রামে ওয়ার্কার্স পার্টি কর্মী নুর ইসলামের বাড়ি ভাংচুর করেছে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী এমপি রণজিত রায়ের পোষ্য সন্ত্রাসীরা।

নীলফামারীতে জামায়াত কর্মী গ্রেফতার
নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষীচাপ ইউনিয়নের লক্ষীচাপ গ্রাম থেকে গোলাম রব্বানী (৩৩) নামে এক জামায়াত কর্মীকে গ্রেফতার করেছে নীলফামারী থানা পুলিশ। নিজ বাড়ী থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

ফেনীতে আটক ২৪
ফেনীতে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীসহ ২৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গত রোববার দিবাগত রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
নরসিংদীর মঈন খান আহত
নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ড. আব্দুল মঈন খানের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয় ১৫ জন আহত হয়েছেন। ড. আব্দুল মঈন খান জানান, নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে পলাশ উপজেলার পারুলিয়া মোড়ে পূর্ব নির্ধারিত উঠান বৈঠকে যোগ দিতে গেলে হামলা করা হয়। এদিকে হাইকোর্ট থেকে জামিন আনতে গিয়ে গায়েবি মামলার আসামি হিসেবে আটক হয়েছেন বেলাব উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বেলাবো থানা বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব বিপ্লব। শনিবার রাত আড়াইটায় নরসিংদীর ডিবি পুলিশের একটি দল তাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে।

সেনা মোতায়েনেও বগুড়ায় কাটেনি শঙ্কা
মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে: ইসির ঘোষণা মোতাবেক রোববার মাঝরাতে সেনা মোতায়েনের পর গতকাল সোমবার সকাল থেকে সীমিত পর্যায়ে সেনা টহল শুরুর মধ্যেও প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও পুলিশের গ্রেফতার ও হয়রানির কারণে উত্তরের জেলা গুলোতে সৃষ্ট একতরফা ভোটের শঙ্কা যেমন কাটেনি তেমনিভাবে জনমনেও ফেরেনি পুরোপরি স্বস্তির ভাব। রোববার সেনা মোতায়েনের রাতেও পুলিশকে আগের চেয়ে একটু বেশিই তৎপর মনে হয়েছে বিরোধী দলের নেতাদের কাছে। বেশ কয়েকটি জায়গায় আগের মতোই সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে ।

বগুড়া বিএনপির সিনিয়র নেতা ফজলুল বারী তালুকদার বেলাল বলেন, ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সরকারের ক্ষমতায় ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই লজ্জা ত্যাগ করে তারা বেপরোয়া সন্ত্রাসে মেতে উঠেছে, তারা চাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট যেন বিরক্ত হয়ে বা ভয় পেয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। তবে সেনাবাহিনীর কার্যকর ভূমিকা পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে বলে আশা ব্যক্ত করেও শঙ্কা নিয়ে বলেন, বাস্তবতা সেনা মোতায়েনের পরেও সরকারি দলের সন্ত্রাসী তাÐবের কোন কমতি দেখা যাচ্ছেনা।

বগুড়া জেলা বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, গতকাল নির্ভয়ে বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়িতে গণসংযোগে বেরিয়েছিল বিএনপির একটি নির্বাচনী প্রচারণা দল। তাদের ধারণা ছিল উপজেলায় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পরে সরকারি দল হয়তো সন্ত্রাসে সাহসী হবেনা। অথচ বাস্তবে ঘটেছে তাদের ধারণার ঠিক উল্টোটাই। অর্থাৎ গোসাইবাড়িতে বিএনপি ৫ আসনের প্রার্থী জিএম সিরাজের প্রচারণা বহরকে দু’ঘন্টা আটকে রেখে বহরের ১০টি মোটরসাইকেল ও দুটি মাইক্রোবাস ভাঙচুর করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে খবর পেয়ে পুলিশ এখান থেকে অবরুদ্ধদের উদ্ধারে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করেছে। এছাড়া গতকালই বগুড়ায় বিএনপির একজন নামকরা ডাক্তার ও অ্যাডভোকেটের মতো সিনিয়র নেতাসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ।
চট্টগ্রামে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের প্রত্যাশা

চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা শফিউল আলম ও স্টাফ রিপোর্টার রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে নির্বাচনের মাঠে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হওয়ার সাথে প্রার্থী, নেতাকর্মী-সমর্থক, সাধারণ মানুষের মাঝে আশা ও আস্থা জেগে উঠেছে। ভোটারদের কথাবার্তায় সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশের ক্ষেত্রে সুবাতাস বইছে। সেই সঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। অনেকেরই কথা হলো, মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর আইন-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা, সব দলের প্রার্থীদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ নিশ্চিত হচ্ছে কিনা এখন তা পর্যবেক্ষণ করছে। সোমবার সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় প্রায় সমানতালে প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগ, সভা-মিছিল, পোস্টার ও ব্যানার লাগানোর কাজে মাঠে তৎপর থাকতে দেখা গেছে। তবে অনেক এলাকায় হয়রানি, ভয়ভীতির ছায়া এখনও রয়ে গেছে।

বন্দরনগরীর তিনটি আসনসহ চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি আসন এবং তিনটি পার্বত্য জেলার তিন আসন মিলিয়ে ১৯টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে সেনাবাহিনী মাঠে দায়িত্ব পালন করছে। সমুদ্র উপকূলীয় স›দ্বীপ উপজেলায় নৌবাহিনী দায়িত্ব নিয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনী আসনে সেনাবাহিনী তিন থেকে পাঁচটি পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। গতকাল প্রথম দিন থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন আসনের ভোট কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন এবং সড়ক রাস্তাঘাটের যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে। মহানগরীসহ উত্তর চট্টগ্রামের নির্বাচনী এলাকাগুলোতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে কক্সবাজার সেনানিবাসের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনে সেখানকার সেনা ক্যাম্পগুলোর সদস্যরা নির্বাচনী মাঠের দায়িত্ব নিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন দৈনিক জানান, সশস্ত্র বাহিনী সিভিল প্রশাসনের সাথে সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে। চট্টগ্রামে টহল শুরু করে সেনাবাহিনী। মহানগরীতে টহল দিতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর টহলে সাধারণ মানুষজন উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন। সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে স্বস্তিতে বিএনপি জোট তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরাও। তাদের নির্বাচনী প্রচার কিছুটা বেড়েছে। তবে আতঙ্ক এখনো পুরোপুরি যায়নি।

এতদিন যে ভয়ের পরিবেশ ছিল সেনা নামায় তাও কাটতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ এখন আশাবাদী। তাদের বিশ্বাস ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকলে তারা নিরাপদ। নিরাপদে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবেন। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদেই বাড়ি ফিরতে পারবেন। প্রতিদ্ব›দ্বী বিশেষ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন। বলেছেন, এবার জুলুম, নির্যাতন, হয়রানি হয়তো কমবে। ভয়ভীতিহীন পরিবেশে বাকি কয়টা দিন তারা প্রচারণা চালাতে পারবেন।

নগরীর নিউমার্কেট এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবদুল মাবুদ ও আন্দরকিল্লার ব্যাংকার ফজলুল হক বললেন, নির্বাচনের মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েন সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ তারা প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পারবে। গ্রেফতারের ক্ষমতার সাথে সাথে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসী পাওয়ার দিতো তাহলে নির্বাচনী পরিবেশ আরও সুন্দর সুষ্ঠু হতে পারতো। তবু আমরা আশাবাদী।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, সকাল থেকে পৌর সদর এবং আশপাশে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হতে দেখে মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে মানুষ এখন নিরাপদবোধ করছে। আশা করি এবারের ভোট শান্তিপূর্ণ হবে।

চট্টগ্রাম-১১ আসনের মহাজোটের নৌকার প্রার্থী এমএ লতিফ বলেন, নির্বাচনী মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ আরও নিশ্চিত হবে। চট্টগ্রাম-৮ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী আবু সুফিয়ান বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার আর হামলায় সরকারি দলের লোকজন ও পুলিশ ভীতিকর পরিবেশ তৈরী করেছে। আমরা আশাকরি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে সেই ভয়ের পরিবেশ আর থাকবে না। ভোটারেরা এখন নিজেদের অনেক বেশি নিরাপদ মনে করবেন। তারা র্নিভয়ে ভোট দিতে যাবেন। সরকারি দল আর পুলিশের বাধার মুখে অনেক এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোটের প্রচারে নামতে পারছে না। আশাকরি দেরিতে হলেও এখন তারা মাঠে নামবে। চট্টগ্রাম-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী জসিম উদ্দিন শিকদার বলেন, ভয়ভীতি আর হুমকি-ধমকির মধ্যেও আমরা প্রচারণা চালিয়ে আসছি। তবে ভোটারদের মধ্যে আমি ভয়ের কিছু দেখিনি। তারা তাদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনঢ়। রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমেছে। এই অবস্থায় ভোটাররা আরও বেশি উজ্জীবিত হবেন। তারা ভয়হীন পরিবেশে ভোট দিতে যাবেন। সেনাবাহিনীকে দেশের মানুষের আস্থার প্রতীক উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা নিরপেক্ষ দায়িত্বপালন করবে এ বিশ্বাস জনগণের রয়েছে। তিনিও আশাবাদী ভোটের মাঠে ভয়ের পরিবেশ আর থাকবে না।

স্বস্তি খুঁজছে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ
রাজশাহী ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা রেজাউল করিম রাজু জানান ঃ নির্বাচনের মাঠে সেনা মোতায়েনে স্বস্তির প্রত্যাশা করছেন রাজশাহী অঞ্চলে নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রবিবার রাত থেকে জেলা উপজেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন, সরকারী দল আর পুলিশের দাবড়ানিতে অস্থির থাকা বিএনপি প্রার্থী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে সাহস যোগাবে এমন আশাবাদ তাদের। প্রত্যাশা সেনাবাহিনী মাঠে তৎপর থাকলে বন্ধ হবে দুবৃত্তপনা। কিন্তু সে চিত্র এখনো দেখা যায়নি। নির্বাচন নিয়ে দম বন্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে।

রাজশাহীর বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে সবাই সেনা মোতায়েনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা আছে। আশা করা যায় সেনাবাহিনী মানুষের আস্থার জায়গাটা ধরে রাখবে। কিন্তু বিভিন্ন জেলায় হামলার খবর পেয়ে ভীত। বাগমারার অটোচালক হামিদুর বলেন সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে। ভাল লাগছে। এবার তারা নিরপেক্ষ মাঠ করুক। আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, ভোটের মাঠে যে একতরফা ব্যবস্থা হয়েছে। সেনাবাহিনী শুধু টহল দিলে হবে না। যে গন্ডগোল করবে তাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশানে যেতে হবে। পুঠিয়া থেকে লিটন জানান, সেখানে সেনা মোতায়েন নিয়ে সাধারন মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সেনা মোতায়েনকে স্বাগত জানালেও নির্বাচনের মাঠে তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারবে তা নিয়েও শংসয় প্রকাশ করেন। কারন তারা থাকবে ষ্টাইকিং ফোর্স হিসেবে।

অনেক তরুণ ভোটার তাদের উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন আমরা ইন্টারনেটে দেখেছি আমাদের সেনাবাহিনী বিদেশে কেমন ভাল করছে। নিজ দেশেও একই রকম করবে। তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেনা মোতায়েন বিষয়ে বলেন, সবে সেনা মাতায়েন হয়েছে। বর্তমানে মাঠের যে হাল তা মসৃন করতে তারা কি কি পদক্ষেপ নেয় তার উপর নির্ভর করছে সবকিছু। সেনাবাহিনী পক্ষপাতহীন ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে দেশের মানুষ এর সুফল পাবে। একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কেন নির্বাচনের সময় তত্বাবধায়ক সরকার দরকার। সর্বত্র পরিস্থিতির যে সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেনাবাহিনীকে শুধু টহল দিলে চলবেনা। সবক্ষেত্রে ডাইরেক্ট এ্যাকশানে যেতে হবে। নইলে ভোটরাদের শংকা কাটবেনা।

পাবনা থেকে মুরশাদ সুবহানী জানান : পাবনায় সেনা বাহিনীর টহল শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা ক্রমেই অপসারিত হবে সে প্রত্যাশা সবার। শহরে এবং উপজেলা সদরে টহল চলছে। পাবনা-৫ সদর আসনে ঐক্যফ্রন্ট নেতৃত্বাধীন বিএনপি জোটের জামায়াতের ধানের শীষের প্রার্থী অধ্যক্ষ ইকবাল হুসাইন শহরের বাজার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শো-ডাউন করেছেন। পাবনা-৫টি আসনের নির্বাচনের সার্বিক চিত্র ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। ভয়-ভীতি দূর হয়নি এখনো। ধারণা করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক ভোটার তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে ভোট কেন্দ্রে যাবেন।

আমাদের নওগাঁ, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, প্রতিনিধি তাদের সেনা মোতায়েনের পর সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলছেন সেনা মোতায়েনে পরিস্থিতি খানিকটা বদলে গেছে। মানুষের মাঝে বিরাজ করা ভীতিকর অবস্থা কাটছে। তাদের তৎপরতা বাড়ালে ভোটের মাঠ মসৃন হবে। মানুষ ভয় আতংক ঝেড়ে ফেলে ভোট উৎসবে মেতে উঠবে। তবে তার প্রতিফলন আরো দু’তিনদিন পর বোঝা যাবে।

দক্ষিণ-পশ্চিমে দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার প্রত্যাশা
যশোর ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা মিজানুর রহমান তোতা জানান, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১ জেলার ৩৬টি আসন এলাকায় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট শুরু হয়েছে। আমাদের মাগুরা কুস্টিয়ার স্টাফ রিপোর্টার, জেলা সংবাদদাতা ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটের মাধ্যমে ভোটের এই মুহূর্তের প্রকৃত মাঠচিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর জনমনে স্বস্তি ফিরবে এম প্রত্যাশা সবার। বিরোধী প্রার্থীদের সঙ্গে নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের দল ভারি হচ্ছে। তবে হামলার আতঙ্ক রয়ে গেছে। ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে নির্ভয়ে দলে দলে হাজির হবেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন এলাকায় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা ঠিকমতো গণসংযোগ করতে পারেননি সেনাবাহিনী নামার আগে। গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়-ভীত কেটে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা হলো, তারা বললেন, নির্বাচনী পরিবেশ এখন ভালো মনে হচ্ছে। মানুষের ভেতরে ‘পেনিক’ সৃষ্টি করা হয়েছিল যাতে ভোটকেন্দ্রে মানুষ না যায়। সেনাবাহিনী নামার পর সেই অবস্থা এখনো কাটেনি। তবে অনেকেই বলেছেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভুমিকা রাখতে। তারা দলমতের উর্ধ্বে ভোটারদের বাঁধা দেওয়া, ভোট কেন্দ্র দখল, ভয় আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে দমন করবেন বলে ভোটারদের দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে।

বরিশালে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন
বরিশাল ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা নাছিম উল আলম জানান, বরিশালসহ দক্ষিনাঞ্চলের ৬টি জেলায় সেনাও নৌবাহিনী অবস্থান গ্রহন করেছে। বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠী জেলায় বরিশালের শেখ হাসিনা সেনানিবাস থেকে কমান্ডিং অফিসার-এর নেতৃত্বে সেনা জওয়ান মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ভোলা ও বরগুনা জেলায় বাংলাদেশ খুলনা কমান্ড থেকে নৌ বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান গ্রহন করেছে। পাশাপাশি উপকূলের কয়েকটি জেলায় কোষ্ট গার্ড ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে বিজিবি সপ্তাহখানেক আগে থেকেই মোতায়েন রয়েছে। রবিবার রাতেই দক্ষিনাঞ্চলের জেলা সদরগুলোতে সেনা ও নৌ বাহিনী স্ব স্ব ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান গ্রহন করে। তবে গতকাল দুপুর পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীর তেমন কোন টহল চোখে পড়েনি। সশস্ত্র বাহিনীর তরফ থেকে ‘এসব বিষয়ে আইএসপিআর ও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারগন কথা বলবেন’ বলে জানান হয়েছে। এব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার এস এম অজিয়র রহমান বলেন, ‘সেনা বাহিনী জেলার ৬টি এলাকায় ইতোমধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেছে।

সেনা বাহিনীর অবস্থান গ্রহণের ফলে সাধারন মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির ভাব লক্ষ করা গেলেও টহল শুরু হলে পরিস্থিতির আরো ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। ঐক্যফ্রন্ট সহ মহাজোটের বিরোধী রাজনৈতিক মহল নির্বাচনী মাঠে আইনÑশৃংখলা রক্ষায় সেনা টহল শুরু সহ সক্রিয় অংশ গ্রহনের অপক্ষোর কথা বলা হয়েছে। তবে গতকালও বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিনাঞ্চলে ধরপাকড় অব্যাহত ছিল। রবিবার মধ্য রাতেও নগরীর বিভিন্ন বস্তির ঘরে ঘরে পুলিশ হানা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। দুপুরে নগরীর আলেকান্দা এলাকা থেকে আরো ৬জন বিএনপি কর্মীকে আটক করেছে মহানগর পুলিশ।

নোয়াখালীতে স্বস্তি চায় নোয়াখালীর ভোটার

নোয়াখালী ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা আনোয়ারুল হক আনোয়ার জানান, দলীয় প্রতীক বরাদ্দের প্রথম দিন থেকে নোয়াখালীর ৬টি আসনে সংঘঠিত নির্বাচনী সহিংসতার কারনে সাধারন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি পায়। প্রায় প্রতিটি আসনে হামলা, ভাঙ্গচুর ও অগ্নিসংযোগ ছিল নিত্যকার বিষয়। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রায় আড়াই শতাধিক ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। সংঘর্ষে উভয় দলের আহত হয়েছে কমপক্ষে তিন শতাধিক। বিভিন্ন আসনে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধাপ্রদান, নির্বাচনী অফিস ভাঙ্গচুর ও পোস্টারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর পাশাপাশি বিরোধী প্রার্থীদের কর্মী সমর্থকদের আটক ও রাতের পুলিশ বাড়ি বাড়ি হানা দেয়ায় সাধারন মানুষের মধ্যে ছিল ভীত সন্ত্রস্থ। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় সংঘাতে কারনে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা যায়।

নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর ধানের শীষ মার্কার কয়েকজন প্রার্থী হামলার শিকার হন। কিন্তু পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। এবিষয়ে ধানের শীষ প্রার্থীরা অভিযোগ করেন যে, হামলার শিকার বিএনপি নেতাকর্মীরা থানা পুলিশের শরনাপন্ন হলে উল্টো তাদেরকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন অভিযোগ কিংবা ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ ও ডিবি পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীকে আটক করছে। এসব কারনে ৬টি আসনে ধানের শীষ প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারনা প্রথম থেকেই হোঁচট খায়। সোমবার প্রথমবার সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে টহল দিচ্ছে। গত কয়েকদিন প্রচার প্রচারণায় বিঘœ ঘটলে ধানের শীষ মার্কার প্রার্থীরা নিজ নিজ অধিকাংশ এলাকায় গনসংযোগ করতে পারেনি। সেনাবাহিনী আসার পর পরিস্থিতি বুঝে প্রার্থীরা পূরো নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগের চিন্তাভাবনা করছে। গতকাল নোয়াখালী-৫ আসনের বিএনপির প্রার্থী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের গাড়ী বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। মওদুদ আহমদের ব্যক্তিগত সহকারি মমিনুর রহমান সুজন অভিযোগ করে বলেন, সকালে পেশকারহাট, বামনী ও মুছাপুরের উদ্দেশ্যে প্রার্থীসহ আমরা গাড়ী বহর নিয়ে বের হই। পথে নতুন বাজার এলাকায় পৌঁছলে পিছন থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গাড়ীতে অর্তকিত হামলা চালায়। এসময় তারা পিছনে থাকা দু’টি গাড়ী ভাঙচুর ও ৫ নেতাকর্মীকে পিটিয়ে জখম করে।

ময়মনসিংহে ঐক্যফ্রন্টেরের মনোবল বৃদ্ধি
ময়মনসিংহ ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা শামসুল আলম খান জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্ট্রাইকিং র্ফোস হিসেবে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। তারা জেলা সদরসহ ময়মনসিংহের ১২ টি উপজেলায় অবস্থান নিয়েছে। এতে মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী, নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও রজলা রির্টানিং কর্মকর্তা ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, নির্বাচনী মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। জেলা সদরসহ প্রত্যেকটি উপজেলায় তারা অবস্থান নিয়ে ইতোমধ্যে টহল শুরু করেছে। তবে তাদের সংখ্যা কত এ বিষয়টি পরে বলা যাবে।

সিলেটে সর্তক সরকার দলের কর্মীরা
সিলেট ব্যুরো থেকে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ফয়সল আমিন জানান, সারাদেশের ন্যায় সিলেটে সেনা বাহিনী সদস্যরা মাঠে নেমেছেন। সিলেট সিটি করপোরেশন সহ উপজেলাগুলোতে অবস্থান গ্রহন করেছেন সেনা বাহিনীর সদস্যরা। ৫০ জন করে সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রবিবার রাতেই সীমান্তবর্তী সিলেট জকিগঞ্জ উপজেলায় পৌছেন। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সেনা সদস্যরা। সিলেটের জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা এম কাজি এমদাদুল ইসলাম বলেন, সারাদেশের মতো সিলেট সিটি করপোরেশন ও ১৩টি উপজেলায় ৫০ জন করে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করা হয়েছে।

সাধারন মানুষ সেনা বাহিনীর উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে মনে করেন। তবে তারা সেনাদের ভুমিকা দেখতে চান। ভোটার নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারে সে পরিবেশ চান। মানুষ প্রত্যাশা করছে ব্যাপক ধরপাকড় সহ মুখী হয়রানীর বিপরীতে, সেনা সদস্যদের উপস্থিতি ভরসা করার মতো একটি স্থান তারা পেয়েছে। এদিকে, সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকার দলের অনেক নেতাকর্মীরা সর্তকতা বহায় রাখছেন। এছাড়া তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসীদের মধ্যে গা-ডাকা দেওয়ার কৌশল শুরু হয়েছে।

দিনাজপুরে সেনাবাহিনীর টহল
দিনাজপুর অফিস থেকে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মাহফজুল হক আনার জানান, সেনাবাহিনী ষ্ট্রাইকিং ফোর্স দিনাজপুরে অবস্থান নিয়েছে। সোমবার দুপুর থেকে জেলা ও উপজেলা শহরে তারা টহল দিতে শুরু করেছে । এ ব্যাপারে জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মাহবুবুল আলম এর মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, দিনাজপুরের ১৩ উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলায় সর্বমোট ১৭ প্লাটুন সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। তিনি জানান, সীমান্ত সংলগ্ন ৬টি উপজেলায় এখনও সেনাবাহিনী অবস্থান নেয়নি। তবে ইতিপূর্বেই ২৮ প্লাটুন বিজিবি সদস্য ষ্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে। এদিকে সেনাবাহিনীর টহল শুরু করায় সাধারন মানুষের মধ্যে স্বস্থির ভাব লক্ষ করা গেলেও এখনো ভয় কাটেনি। সেনারা নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করবে না পুলিশের সহায়তা করবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে মানুষ।

খুলনায় সেনা মোতায়েন খুলনা ব্যুরো থেকে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার আবু হেনা মুক্তি জানান, খুলনাঞ্চলে সেনা মোতায়েনের পর কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি ক্ষমতসীন দলের প্রার্থী ও নেতারা আরো বেশি নড়েচড়ে বসেছে। নির্বাচনী মাঠে তাদের কর্মকান্ড মুহুর্তেই আরো বেগবান হচ্ছে। কিন্তু মানুষ দেখতে চায় সেনারা নিরপেক্ষ থেকে নির্বাচন সম্পন্ন করেন।–ইনকিলাব