কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার তিন আসনে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষের কাণ্ডারি হওয়া নিয়ে ছিল নানা গুঞ্জন। কে হচ্ছেন খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী- স্থানীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সারাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক দিন ধরে ঘুরপাক খেয়েছে এ প্রশ্ন। আইনি জটিলতায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলে প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল দলের ‘হেভিওয়েট’ নেতাদের। তবে গতকাল বুধবার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে এর মধ্যে একটি আসনে ‘নাটকীয়’ ঘটনা ঘটেছে। এদিন বগুড়া-৬ (সদর) আসনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে শাজাহানপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ মিল্টন এবং ফেনী-১ (পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া) আসনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
কয়েক দিন ধরে খালেদা জিয়ার আসনে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ। ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী হিসেবে আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দলীয় মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছিল। তিনি নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে আইনজীবীর মাধ্যমে যাবতীয় প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল ফেনী জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দেননি মিন্টু। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। নির্বাচন না করলে মিন্টু কেন দলীয় মনোনয়নপত্র নিয়েছিলেন? অবশ্য আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেয়ে নির্বাচন পরিচালনায় তার সময় দেওয়া ও অবদান রাখা উচিত। নির্বাচন পরিচালনায় দলে এখন পর্যাপ্ত ও অভিজ্ঞ লোকজনের অভাব রয়েছে। তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, কিছু নেপথ্য কারণ।
সূত্র জানায়, স্বাধীনতার আগে ও পরে দীর্ঘসময় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। একইসঙ্গে তখন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দ্বৈত নাগরিকত্বের আইনগত জটিলতার আশঙ্কায় মূলত নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছেন না এফবিসিসিআইর সাবেক এ সভাপতি। তার আইনজীবীরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আইনগত অসুবিধা না হওয়ার যুক্তি দিলেও ঝুঁকি নিতে রাজি হননি মিন্টু।
দলের অপর একটি সূত্র দাবি করেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মঙ্গলবার রাতে লন্ডন থেকে টেলিফোনে আবদুল আউয়াল মিন্টুকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অনুরোধ করেন। জানা গেছে, মিন্টুকে পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনায় তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনকালে ঢাকায় অবস্থান করে দলের কেন্দ্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করলে ভালো ফল আসবে। বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতা নিজ নিজ এলাকায় ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে সাড়া দিয়ে মিন্টু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বলে দাবি করছে ওই সূত্র।
আবার আরেকটি সূত্রের দাবি, আবদুল আউয়াল মিন্টু শুরু থেকে ফেনী এলাকায় প্রার্থী হতে চাননি। ফেনী-৩ আসন থেকে তার ছোট ভাই দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আকবর হোসেনকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। ঢাকার একটি আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু দলের হাইকমান্ডের অনুরোধে নিজ আসন ফেনী-৩ (দাগনভূঞা এবং সোনাগাজী) এবং খালেদা জিয়ার আসন ফেনী-১ (পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া) আসন থেকে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি দুটি আসন থেকেই নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে তার সঙ্গে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে ফেনী-১ আসনে যুবদল নেতা রফিকুল আলম মজনু এবং ফেনী-৩ আসনে দলের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল লতিফ জনিকে রাখায় ক্ষুব্ধ হন মিন্টু। অবশ্য জনির পাশাপাশি ফেনী-৩ আসনে তার ছোট ভাই আকবর হোসেনকেও বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে। মিন্টু তার মতো হেভিওয়েট নেতার সঙ্গে দ্বিতীয় বিকল্প প্রার্থী রাখায় অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ফেনীর আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল না করার বিষয়ে গতকাল বলেন, আমার কখনই নির্বাচন করার শখ ছিল না। পরিবারের মধ্যে আমার বাবা-ভাই নির্বাচন করেছেন। অতীতে আমি কখনও নির্বাচনে অংশ নিইনি। এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা গ্রেফতার-মামলা-হয়রানির মুখে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দলের বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচন না করে দলের নির্বাচনের কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নির্বাচন করার চেয়ে নির্বাচনী কাজে সময় ও শ্রম দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, দলও মনে করে, নির্বাচন পরিচালনার কাজে তার সম্পৃক্ত থাকা প্রয়োজন। তার মনোনয়নপত্র দাখিল নিয়ে যেসব খবর গণমাধ্যমে আসছে, তা সঠিক নয়। এ নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি মহল।
সূত্র জানায়, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও নিজ আসনের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন। মিন্টুকে দলের হাইকমান্ড খালেদা জিয়ার আসন থেকে মনোনয়নপত্র নিতে বলায় তিনি নিশ্চুপ হয়ে যান। এর আগে নবম সংসদ নির্বাচনেও তিনি বগুড়ায় খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া আসন থেকে উপনির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারও তার নিজ আসনটি ছেলে ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরকে দিয়ে বগুড়ায় খালেদা জিয়ার একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনিও নবম সংসদে বগুড়ায় খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ওই সময় মওদুদ এবং জমিরউদ্দিন দু’জন নিজ নিজ আসনে পরাজিত হয়েছিলেন।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার সকালে ঢাকা থেকে বিমানে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দল থেকে আমাকে বলা হয়েছে বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য। খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার কথা আমরা কখনও ভাবিনি। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
ফেনী-১ আসনে বিকল্প প্রার্থী যুবদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রফিকুল আলম মজনু গতকাল বলেন, আমরা আশা করি, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন। তার পক্ষে আমিসহ দলের সবাই কাজ করব। আইনি জটিলতায় চেয়ারপারসন নির্বাচন করতে না পারলে আমি নির্বাচন করব।
বগুড়ায় খালেদা জিয়া ও মির্জা ফখরুলের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন নেতারা :বগুড়া ব্যুরো জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে বগুড়া-৬ সদর আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে রিটার্নিং অফিসার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুর রহমান, রেজাউল করিম বাদশা, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান, বিএনপি নেতা আলী আজগর হেনা, লাবলী রহমান, পরিমল কুমার চন্দ প্রমুখ। বিকেলে মির্জা ফখরুল ইসলামের পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন সাইফুল ইসলাম। এ সময় দলীয় নেতাকর্মীর ভিড় দেখে জেলা প্রশাসক আপত্তি করেন।
বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়ার পক্ষে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সাংসদ হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু। সেখানেও প্রায় ২০/২৫ জন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র দাখিল করেন নেতাকর্মীরা :ফেনী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক, ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী প্রতিনিধি জানান, ফেনী-১ (পরশুরাম-ফুলগাজী-ছাগলনাইয়া) আসনে মোট ১২ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে রিটার্নিং অফিসার জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামানের কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী রেহানা আক্তার রানু। খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক আবুল কাসেম ও সমর্থক হিসেবে স্বাক্ষর করেন আহাম্মদ আযম চৌধুরী। এ আসনে বিএনপির বিকল্প প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন ঢাকা মহানগর যুবদল দক্ষিণ সভাপতি রফিকুল আলম মজনু। এর আগে এ আসনে মহাজোট প্রার্থী শিরীন আখতার রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন শেখ আবদুল্লাহ ও আবুল বশর তপন। খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল লতিফ জনি, কেন্দ্রীয় নেত্রী রেহানা আক্তার রানু, জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু তাহের, পরশুরাম উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব প্রমুখ।
মনোনয়নপত্র জমা দেননি আলাল ও সোহেল :নির্বাচনে অংশ নিতে গতকাল শেষ দিনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেননি দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল।
আলাল বরিশাল-৫ আসনে প্রার্থী হতে চাইলেও তাকে শেষ পর্যন্ত বরিশাল-২ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থিতা চেয়েছিলেন কারাবন্দি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। তাকে ঢাকা-৯ আসন থেকে নির্বাচন করতে মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল। এ কারণে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ছাত্রদল নেতা নাহিদুল ইসলাম সুহাদ।
আলালের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রথমত বরিশাল সদর আসনে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন আলাল। তারপরও বরিশাল-২ আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে সংস্কারপন্থিসহ আরেকজন নেতাকে। এতে আলালের ক্ষোভের পারদ বেড়ে যায় এবং তিনি দলের মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, যে নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অংশগ্রহণ করতে পারছেন না, সে নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেন না। বিএনপি তো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপনি কেন বর্জন করলেন- এমন প্রশ্ন করা হলে আলাল বলেন, তিনি যে আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন এবং যে আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন, সেসব আসনে একাধিক বিকল্প প্রার্থী রয়েছে। তাই তিনি নির্বাচনে অংশ না নিলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, নির্বাচনও থেমে থাকবে না।