প্রাথমিকভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর অন্তত ৩০টি আসনে নতুন করে হিসাব কষছে আওয়ামী লীগ। আগে করা বিভিন্ন সংস্থার জরিপ ও মাঠের পরিস্থিতির মধ্যে ফারাক থাকায় নতুন করে এ চিন্তা ভাবনা। শেষ মুহূর্তে এসব আসনে প্রার্থী হেরফের হতে পারে।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে এসব আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও শেষ মুহূর্তে এসে আবার কাটছাঁট করা হচ্ছে। চার কারণে এ কাটছাঁট বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এর মধ্যে রয়েছে দলীয় কোন্দল, বিভেদ, অধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী আর জোটের হিসাবনিকাশ। কয়েকটি জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে ওইসব আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। পরে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলের অন্য নেতাদের কয়েক দফা আলোচনা হয়। তাদের আলোচনার সঙ্গে জরিপের ফলাফলে কিছুটা অমিল পাওয়া যায়। এরপরই দলীয়ভাবে আবারও ওইসব আসন পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। জনপ্রিয়তার বাইরে কেউ যেন মনোনয়ন না পান সে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রার্থী বাছাই নিয়ে কোনো ধরনের ভুল করতে চায় না আওয়ামী লীগ। তাই কিছু আসনে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ তালিকা ২৫ থেকে ৩০টির বেশি নয়। দলীয় নেতারা জানান, এরই মধ্যে ঢাকা থেকে কয়েক নেতাকে সংশ্লিষ্ট আসনগুলোতে পাঠানো হয়েছে। অনেকটা গোপনে গিয়ে তারা নির্বাচনী আসনের ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানের সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করছে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের গবেষণা সংস্থা। তাদের মতামতের ভিত্তিতে ওইসব আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এসব আসনের কারণে আওয়ামী লীগ এখনও প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করছে না। তবে সোমবারের মধ্যে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানান তারা।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার জানান, কিছু আসনে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যারা ইলেক্টেবল ও উইনেবল তাদেরই আমরা সিলেক্ট করবো।
দলের কয়েক নেতা জানান, শেরপুর-৩ আসনের প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে আবারও নতুন করে রিপোর্ট সংগ্রহ করা হচ্ছে। নওগাঁর দুটি আসনের বিষয়েও নতুন করে রিপোর্ট নেয়া হচ্ছে। ঝিনাইদহ, যশোর, পিরোজপুরের একটি করে আসনের বিষয়ে নতুন তথ্য নেয়া হচ্ছে। বরিশাল-৩ ও পটুয়াখালী-৪ আসনেও মহাজোটের প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে তথ্য নেয়া হচ্ছে। বরিশাল-৩ আসনটি নিয়ে মহাজোটের শরিক দু’দল জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেউ কাউকে আসনটি ছেড়ে দিতে চাইছে না। উল্টো নতুন করে বরিশাল-২ আসন চাইছে জাতীয় পার্টি।
এ বিষয়ে এখন আওয়ামী লীগ কোনো গ্রিন সিগন্যাল দেয়নি। যশোর-২ আসনের খসড়া মনোনয়ন তালিকা সংশোধন হতে পারে ওই আসনের রিপোর্ট পাওয়ার পর। বর্তমান এমপি ও সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রী মনোনয়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, সবদিক বিবেচনা করে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হচ্ছে। যাদেরকে প্রার্থী করা হবে তাদের বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত করা হবে। দলের নেতারা জানান, সব মিলিয়ে মনোনয়নের ক্ষেত্রে চলছে শেষ মুহূর্তের যোগ-বিয়োগ। শরিকদের জন্য ৬০-৭০ আসন ছেড়ে তৈরি করা হচ্ছে দলীয় মনোনয়ন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের টিকিট পেতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন চার হাজার ২৩ জন। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের নাম কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে নানা প্রচারণা, গুজব। এ অবস্থায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গণভবন থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন এমন ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন পর্যন্ত চুপচাপ থাকলেও মনোনয়ন নিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল করছেন প্রার্থীর পক্ষে তাদের কর্মী-সমর্থকরা।
শেষ মুহূর্তে মনোনয়নের জন্য প্রার্থীরা দৌড়ঝাঁপ করছেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বাসা এবং অফিসে। মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের অফিস ও বাড়িতেও ভিড় লেগে আছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে দলীয় সভাপতির সাক্ষাৎ প্রত্যাশী নেতাদের নিরাশ করছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কয়েকদিন ধরে রাতে গণভবনে অনানুষ্ঠানিক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার কথা শেখ হাসিনা ধৈর্যসহকারে শুনছেন ও জবাব দিচ্ছেন। আবার অনেকের কথার সূত্র ধরে তিনি অতীত ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তবে সবাইকে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে গণভবনের হলরুমে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় নেতারা স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।
গোপালগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় বর্তমান এমপি লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খানের নাম উঠে এসেছে। আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করে বৃহস্পতিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য মুকুল বোস। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে নিজের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, নেত্রী আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর প্রতিবাদ করেছিলাম। এ কারণে অনেক নির্যাতন-জুলুমের শিকার হয়েছি। এ সময় তাকে থামিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছ, আবার ১৯৮১ সালে আমার দেশে ফেরার বিরোধিতাও করেছ। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলে। কী, এসব করনি মুকুল বোস? এ সময় মুকুল বোস কোনো কথা বলেননি বলে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান।
সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ’৬৯ সালে তাড়াশ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান, দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। ২০১৪ সালে উপনির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানিয়েছেন। আমি নির্বাচনী এলাকার সংগঠনগুলো গুছিয়েছি। রায়গঞ্জের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করেছি, যা আগে কখনও কেউ জিততে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। এবার আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চাই। ৬৯ বছরের বয়সের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কাছে নৌকা চেয়ে বিদায় নিচ্ছি।
নেত্রকোনা-২ আসনে বর্তমান এমপি আরিফ খান জয়কে প্রার্থী না দেয়ার দাবি করেন এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী শামসুর রহমান ওরফে ভিপি লিটন। নেত্রকোনা-৩ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দলের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এ আসনে দলের মনোনয়ন চান জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে নির্বাচনী এলাকায় নিজের কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন তিনি এবং কান্নাকাটি করেন। নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তাকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানান। কেশবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কেন্দুয়া পৌর মেয়র আসাদুজ্জামান বলেন, নেত্রী আমরা শুনতে পারছি, আপনি একজন ত্যাগী, কারা নির্যাতিত কেন্দ্রীয় নেতাকে নৌকা দিচ্ছেন। তিনি যোগ্য প্রার্থী। আমরা কথা দিচ্ছি আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করে আসনটি উপহার দেব। অসীম কুমার উকিলের পক্ষে কেন্দুয়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল বক্তৃতা করেন। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, অসীম কুমার উকিল নিয়মিত এলাকায় যাচ্ছেন এবং নেতাকর্মীদের আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাকে নৌকা দিলে জয় নিশ্চিত।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবিনা আকতার তুহিনসহ কয়েকজন বক্তৃতা দিতে চাইলে শেখ হাসিনা তাদের থামিয়ে দেন।
সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল