ঘুরতে কার মন না চায়! আর সেই ঘোরাঘুরি যদি কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনায় হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এক কথায়, সোনায় সোহাগা। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো অবস্থা। ক্লাস, টিউটোরিয়াল, পরীক্ষা বিরতিহীনভাবে চলতে থাকায় সপ্তাহে তেমন কোনো লম্বা ছুটি নেই। প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার ছুটি মিললেও ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তাই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। এই সুযোগ যে এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো আমরা তা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি।
ক্যাম্পাস প্রায় ৩০ দিনের মতো বন্ধ। সবাই নিজেদের মতো করে ছুটি উপভোগ করছে। আমরা এই সুযোগটা কাজে লাগালাম। নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্য সীতাকোর্ট বিহার দেখতে যাব। যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ। গত ২৫ জুন আমি আর বেলাল রংপুর হয়ে দিনাজপুরে পৌঁছাই। পথিমধ্যে বন্ধু আবু সুফিয়ান আমাদের সাথে যোগ দেয়। দুপুরের দিকে আমরা পৌঁছে যাই দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায়, যেখানে এই সীতাকোর্ট বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। নবাবগঞ্জে পৌঁছা মাত্রই দিনাজপুরের বন্ধু জাকিয়া ফারজানা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। দুপুরে আমরা তার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করি। বিকেল ৪টার অল্প কিছুক্ষণ পর চার বন্ধু মিলে সীতাকোর্ট বৌদ্ধ বিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। প্রায় ১ ঘণ্টার মধ্যেই গন্তব্যে স্থলে পৌঁছে যাই। সেখানে গিয়ে সীতাকোর্ট বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কিত একটি বড় বোর্ড দৃষ্টিগত হয়। সেখান থেকে সীতাকোর্ট সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারি। সীতাকোর্ট বিহার সম্পর্কে জানার পর নিজেদের কাছে নিজেদেরকেই বিস্ময় হয়। মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো এক ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করেছি। নবাবগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে সীতাকোর্ট বৌদ্ধ বিহার অন্যতম। জনশ্রুতি আছে, পঞ্চম শতাব্দির আগে এ বিহার নির্মিত হয়েছে। রামের স্ত্রী সীতা এখানেই বনবাসে ছিলেন বলে এর নাম সীতাকোর্ট। পরে জানতে পারি এটি বৌদ্ধ বিহারও ছিল। নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে বিরামপুরগামী পাকা রাস্তার পাশে গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের ফতেপুর মাড়াসপুর গ্রামে এই প্রত্নকীর্তির অবস্থান। এটি প্রায় ১ একর ভূমির ওপর নির্মিত। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৮ ও ১৯৭২ সালে আংশিক খননের পর দেখা গেছে এটি শুধু সীতার কুঠরিই ছিল না, ছিল প্রাচীন একটি বৌদ্ধ বিহার। সীতাকোর্ট বিহার সম্পর্কে আরো বেশি জানতে উইকিপিডিয়ায় সার্চ দিই। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, সীতাকোর্ট বিহার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বায় ২১৪ ফুট, উত্তর দক্ষিণে প্রস্থ ২১২ ফুট। শৌচাগার ছাড়া ছোট বড় কক্ষের সংখ্যা ৪১টি। বেষ্টনি প্রাচীর চওড়ায় সাড়ে ৮ ফুট, সামনের প্রাচীর ৫ ফুট, বারান্দা ৮ ফুট ও বারান্দার সামনের প্রাচীর ৫ ফুট। ভেতরের আঙিনা ১৩৯-১৩৫ ফুট আয়তনের। কক্ষে প্রবেশের পথ ৩ থেকে ৫ ফুট প্রশস্ত। কক্ষগুলো ১১-২২ থেকে ১১-১১ ফুট আয়তনের। মূল প্রবেশ পথ উত্তর দিকে। পথের দু-পাশে পাশাপাশি দুটি করে ৪টি ছোট কক্ষ রয়েছে। বিভক্ত প্রাচীর ১৩ ফুট, ৫ ফুট ও ৪ ফুট প্রশস্ত। বর্তমানে বিহারটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত অন্য বিহারের চেয়ে এটি সবচেয়ে প্রাচীন। নির্মাণশৈলী দেখে অনুমান করা যায়, এ বিহার পঞ্চম শতাব্দি কিংবা তারও আগে নির্মিত হয়েছিল।
তবে বর্তমান অবস্থা আর আগের মতো নেই। ভেতরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যে ক’টি কূপ ছিল সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। বাইরে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে পাশাপাশি অবস্থিত যে কুঠরিগুলো ছিল সেগুলোও প্রায় বিলিনের পথে। মূলত সংরক্ষণের অভাবে এখন এই পুরাকীর্তির বেহালদশা। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, বিহারটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ প্রয়োজন। তাহলে শুধু একটি প্রাচীন ঐতিহ্যকেই সংরক্ষণ করা হবে না, পর্যটকদের কাছেও দর্শনীয় স্থান করে তোলা যাবে।