মালয়েশিয়ায় আদম ব্যবসায় দুই দেশের যৌথ সিন্ডিকেট

দেশে পর্যাপ্ত আয় করতে না পারায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে আব্দুল মজিদ (ছদ্ম নাম) বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি ঢাকার একটি আদম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেন। প্রথমে তাকে বলা হলো ৩৭ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে। পরে সেটা বেড়ে দাঁড়ালো ৭০ হাজার টাকা। সবশেষে মালয়েশিয়া যেতে ওই শ্রমিককে খরচ করতে হলো সাড়ে চার লাখ টাকা।

সূত্র জানিয়েছে, মূলত বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সমঝোতায় একটি সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। ওই সিন্ডিকেট কাজের সন্ধানে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশে জনশক্তি রফতানির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে উঠে পড়ে লেগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিন বিন আব্দুর নূরের কোম্পানি বেসটিনেট। অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় দাতু টাইটেল পাওয়া আমিনের বেসটিনেট কেলেংকারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ার কয়েকজন মন্ত্রীর সহায়তায় সিনারফ্লাক্স নামে নতুন কোম্পানির যাত্রা করেন তিনি। আমিনকে সিনারফ্ল্যাক্স তৈরি করতে সাহায্য করেন ওই দেশের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজমি খালিদ, শ্রম বিভাগের সাবেক পরিচালক টেংকু ওমরসহ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এই কোম্পানিকেই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়ার সরকার। তারা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ১০টি এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ করে।

আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি প্লাস (সরকারি-বেসরকারি) সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী অনলাইনে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মী পাঠানো শুরু হলে গত ১৭ মাসে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গেছেন এক লাখ ৭৯ হাজার ৩৩০ জন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ’র (বায়রা) সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে কাজ পাওয়া ১০টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা বেশ প্রভাবশালী। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো:

১. ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড: যার মালিক ইউনিক গ্রুপের মালিক মো. নূর আলী। যিনি একসময় জনশক্তি রফতানিকারকদের সমিতি বায়রার সভাপতিও ছিলেন।

২. প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস: যার মালিক আরিফ আলম। তিনি বাংলাদেশের এক মন্ত্রীর শ্যালক।

৩. ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল: যার মালিক বায়রার মহাসচিব মো. রুহুল আমিন।

৪. আল ইসলাম ওভারসিজ: যার মালিক পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক জয়নাল আবেদীন জাফর।

৫. সানজারি ইন্টারন্যাশনাল: যার মালিক শেখ আবদুল্লাহ। তার সঙ্গে যুক্ত আছেন একজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এক প্রটোকল কর্মকর্তা।

৬. ক্যারিয়ার ওভারসিজ: যার মালিক রুহুল আমিন, বদরুল আমিনসহ তিন ভাই। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন সরকারের আরেকজন মন্ত্রী এবং একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের সম্পাদক।

৭. রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল: যার মালিক বায়রার সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ বশির।

৮. আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস: যার মালিক মো. রুহুল আমিন।

৯. প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম: যার মালিক বায়রার সাবেক সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা। তার সঙ্গে যুক্ত আছেন ছাত্রলীগের একজন সাবেক সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের প্রথমসারির একজন নেতা।

১০. আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট: যার পরিচালক তুহিন সিদ্দীকি।

সরকারি হিসাব মতে, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর খরচ সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। কিন্তু এই সিন্ডিকেট কর্মীদের কাছ থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়। জনপ্রতি সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা করে ধরলে গত দেড় বছরে এই চক্র অতিরিক্ত হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

মালয়েশিয়ায় নাজিব সরকারের সময় থেকেই এই দুর্নীতি চলে আসছিল। যার সঙ্গে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি এবং তার পরিবারের নামও শোনা যায়। তবে আমিনের দাতু টাইটেল পাওয়া বা শ্রমিক নেওয়ার নামে মনোপলি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি মাহাথির সরকারের কাছে বার বার অস্বীকার করে আসছেন জাহিদ হামিদি। তবে একটি কোম্পানির মনোপলি ব্যবসার মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে গত জুন থেকে বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে মালয়েশিয়া সরকার।