অনেক শিশু মনের আনন্দে স্কুলে যাচ্ছে। আবার কিছু শিশু স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই নানা বায়না করে না যাওয়ার জন্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুবিধার কথা বলে। ক্রমাগত এমন হতে থাকলে অভিভাবকদের একটু সচেতন হতে হবে। প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কেন শিশু স্কুলে যেতে চায় না। কেন তার মন চাচ্ছে না কিংবা সে কোনো কিছুতে ভয় পাচ্ছে কি না। সঠিক কারণ খুঁজে বের করা গেলে এ সমস্যার সমাধান সহজ হবে।
সম্ভাব্য কারণ
প্রতিটি শিশুর নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার জগৎ আলাদা। শিশুর মানিয়ে নেওয়া, ধারণক্ষমতা এবং বিভিন্ন ঘটনার শিশুদের প্রতিক্রিয়াও আলাদা হয়। তাই শিশুর স্কুলে যেতে না চাওয়ার পেছনে যেকোনো কারণ থাকতে পারে। অভিভাবকদের শিশুর পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে বিশেষভাবে লক্ষ রাখলে এবং সে বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। সাধারণভাবে স্কুল অনীহার কারণ হতে পারে—
♦ সাধারণত শিশু তিন বা চার বছর পর্যন্ত পরিবাবের সঙ্গে থাকে। আশপাশের পরিচিত গণ্ডি থেকে হঠাৎ করে স্কুলের নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনেক শিশুই ঘাবড়ে যায়। একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের শিশুরা এ অবস্থার শিকার হয় বেশি। স্কুলে যেতে না চাওয়ার একটি বড় কারণ এই সেপারেশন অ্যাংজাইটি। ছোট শিশুরা তার ভরসার জগৎ ছাড়া নিরাপদ বোধ করে না। স্কুলে গেলে মা ও পরিবার থেকে দূরে থাকতে হবে, এ ভয়েই অনেক শিশু স্কুলে যেতে চায় না। এ ক্ষেত্রে স্কুলের প্রথম দিকে কিছুক্ষণ ক্লাসরুমে অভিভাবক কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো হয়। এরপর কয়েক দিন ক্লাসরুমের বাইরে বসা যেতে পারে, যেন শিশু জানালা দিয়ে চাইলেই তাঁকে দেখতে পায়। এর পরও অভিভাবক স্কুলে থাকবেন কিন্তু ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেখা না করাই ভালো। তবে শিশু জানবে তার আপন কেউ স্কুলেই আছে। স্কুলের প্রতিটি পর্যায়ে শিশুকে প্রশংসা করতে হবে, যাতে সে উত্সাহ পায়।
♦ স্কুলে অভ্যস্ত শিশুরা হঠাৎ করে স্কুলে যেতে না চাইলে সময় নিয়ে তার সঙ্গে এ বিষয় কথা বলুন। হঠাৎ করে শিশুর স্কুলভীতির আরেকটি কারণ হতে পারে বুলিং। অপেক্ষাকৃত শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল শিশুদের অন্য শিশুরা বা বড় ক্লাসের শিশুরা শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে কষ্ট দিতে পারে। অর্থাৎ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা, তাকে হেয় করা ও বিভিন্নভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করা হয়। অল্পস্বল্প দুষ্টুমি বন্ধুদের মধ্যে হতেই পারে; কিন্তু তা যদি আরেক শিশুর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সে ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক দুই পক্ষকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এসব মাত্রাতিরিক্ত বুলিং অনেক ক্ষেত্রে শিশুর ভয়ানক মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে শিশু হীনম্মন্যতা নিয়ে বড় হয় এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
♦ সাধারণত স্কুলে না যাওয়ার পেছনে পড়াশোনার চেয়ে স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষক ও সহপাঠীদের আচরণ অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। শিক্ষকরা যদি অতিরিক্ত কঠোর হন, শিশু তখন অসহায় বোধ করে। সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না হলেও স্কুলে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। স্কুলের পড়ালেখার ধরন ও পরিবেশ যদি আনন্দদায়ক না হয় তাহলেও শিশুর অনীহা হতে পারে। শিশুরা নতুনত্ব আশা করে। তাই শিশু শিক্ষায় নতুনত্ব রাখতে হবে। ক্লাসরুমের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে পাঠদানের ধরন—সবই শিশুর মনমতো হতে হবে এবং অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো, শিশুর পছন্দমতো স্কুল খুঁজে বের করা।
♦ পড়াশোনার জন্য কোনোভাবেই শিশুকে শারীরিক বা মানসিক ভয়ভীতি দেখানো যাবে না। এতে শিশুর মনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এখনকার স্কুলে হোম ওয়ার্কের চাপ খুব বেশি থাকে, যা শিশুর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যায়। দিনের বেশির ভাগ সময় স্কুলে থাকার পর আবার বাসায় এসে হোমওয়ার্ক করতে শিশুর ভালো লাগবে না। তাই স্কুল এমন হওয়া উচিত, যেন বাড়ির কাজের চাপ কম থাকে এবং শিশু তার স্কুল ও শৈশবকে উপভোগ করতে পারে।
♦ সব শিশুর মেধা এক রকম হবে না। পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে বন্ধু, শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্য শুনলে শিশু স্কুলে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। এ বিষয়ে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবক দুই পক্ষকেই সচেতন হতে হবে।
♦ স্কুল কারিকুলাম হতে হবে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বর্ধনে সহায়ক। স্কুলের শিক্ষাই ঠিক করে দেবে শিশুর ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে। শিশুর পড়ালেখা আনন্দদায়ক উপায়ে করাতে হবে, যাতে শিশু পড়ালেখাকে কখনো চাপ বা বোঝা মনে না করে। শিক্ষকরা যদি একটু আন্তরিক হন, শিশুকে স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে ধৈর্য নিয়ে পড়ালেখা করান, তাহলে শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।