ওয়েস্ট ইন্ডিজে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পেছনে রয়েছে দলের পাঁচ সিনিয়র খেলোয়াড়ের অবদান। তরুণেরা বরাবরের মতোই অধারাবাহিকতা ধরে রাখার ব্যাপারে ধারাবাহিক!
২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দল বেশ ধারাবাহিক। আশ্চর্য রূপান্তর বলতে যা বোঝায় আর কি। আর তাই ২০১৯ বিশ্বকাপ ঘিরে এখন থেকেই রঙিন স্বপ্ন আঁকছেন অনেকে। কষ্টের ব্যাপার হলো, কল্পনার ক্যানভাসে তাঁদের এই আঁকাআঁকির তুলি মাত্র পাঁচটি। অথচ, এই ‘পঞ্চপাণ্ডব’-এর বাইরে এ সময়ের মধ্যে অনেকেরই তুলি হয়ে ওঠার কথা ছিল, প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু আপাতত সে সব প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ।
‘পাঁচটি তুলি’ কী, সেটি আগে খোলাসা করা যাক। ভারতীয় ক্রিকেটে শচীন-সৌরভদের যুগে একটা বিশেষণ প্রচলিত ছিল ‘ফ্যাবুলাস ফাইভ’—সংক্ষেপে ডাকা হয় ‘ফ্যাব ফাইভ’। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ ও অনিল কুম্বলে। ভারতীয় ক্রিকেটের পাঁচ দিকপাল। একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটও এমন পাঁচ দিকপালে সওয়ার হয়েছে। নামগুলো কি বলতে হবে?
দলে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের অভাব নেই। তাঁদের প্রতিশ্রুতি যে মাঠে অনূদিতও হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু বড্ড অনিয়মিত, এতটাই যে সাহারা মরুভূমির ঊষর বুকে বছরে একটা বৃষ্টিপাতের মতো! তাতে কী দলের প্রয়োজন আর সমর্থকদের খিদে মেটে? গত কয়েকটি বছর ধরে ক্লান্তিহীনভাবে যাঁরা এসব মিটিয়ে যাচ্ছেন তাঁরাই আমাদের ‘ফ্যাবুলাস ফাইভ’—মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদউল্লাহ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওয়ানডে সিরিজটা এই ‘ফ্যাব ফাইভে’ সওয়ার হওয়ার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। ২-১ ব্যবধানে বাংলাদেশের এই সিরিজ জয়ের পেছনে দলের সেই সিনিয়র পাঁচ খেলোয়াড়ই। তরুণেরা সেভাবে আলো ছড়াতে পারলেন কোথায়? রানে তামিমের ধারেকাছেও কেউ নেই। দুই সেঞ্চুরি আর এক ফিফটিসহ ২৮৭—ওয়েস্ট ইন্ডিজে সফরকারী দলের পক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। শুধু কী তাই? এই সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে শীর্ষ পাঁচ রান সংগ্রাহক সেই ‘ফ্যাব ফাইভ’ই!
তামিমের পর সাকিব (১৯০), মাহমুদউল্লাহ (১১০), মুশফিক (১১০) ও মাশরাফি (৩৭)। শেষ নামটা দেখে কী হাসি পাচ্ছে? বরং দুঃখ লাগার কথা। যেখানে এনামুল হক, সাব্বির রহমান ও মোসাদ্দেক হোসেনের মতো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ব্যাটসম্যান রয়েছেন, সেখানে মাশরাফি কীভাবে শীর্ষ পাঁচে! তাও আবার শুধু শেষ ম্যাচেই ২৫ বলে ৩৬ রানের ইনিংস দিয়ে। এই সিরিজে তামিম-সাকিবের জুটির কথাও আলাদা করে বলতে হয়। তিন ম্যাচে দুজনের জুটিতে যোগ হয়েছে মোট ৩৮৫ রান। একটি ওয়ানডে সিরিজে যা বাংলাদেশের যে কোনো জুটির সর্বোচ্চ অবদান। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে নির্দিষ্ট কোনো জুটির সর্বোচ্চসংখ্যক রানও।
জবাবটা সবাই জানেন। তরুণেরা তাঁদের মতোই করেই খেলে যাচ্ছেন। মাঠে নামার আগে প্রতিশ্রুতির আবির ছড়িয়ে ময়দানি লড়াইয়ে ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ হচ্ছে। এ নতুন নয়, আর নতুন নয় বলেই পুরোনোদের বারবার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। এই সিরিজে যেমন, তিন ম্যাচে সাব্বিরের অবদান ২৭ (১২, ১২, ৩), মোসাদ্দেকের ১৪* (১১* ও ৩*)। যদিও বল হাতে উইকেট না পেলেও বেশ কার্যকরী ছিলেন তিনি। আর এনামুলের সংগ্রহ ৩৩ (০, ২৩, ১০)। এদিকে আরেকটি বিশ্বকাপ দোরগোড়ায়। বিশ্বকাপের দলে থাকতে তরুণেরা যদি এখন থেকেই সুযোগগুলো নিতে না পারেন তাহলে আর কবে?
আর তাই আপাতত বিশ্বকাপে ঘুরে ফিরে সেই পাঁচ অভিজ্ঞ ‘তরুণ’-ই বাংলাদেশের সবেধন নীলমণি ‘পাঁচ তুলি’। এ ছাড়া উপায় কি? বোলিংয়ের কথা উঠলেও উপায় নেই। এই সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট মাশরাফির। শীর্ষে থাকা তিন বোলারের দুজনই পোড় খাওয়া—মাশরাফি ও রুবেল। তরুণদের মধ্যে আছেন শুধু মোস্তাফিজুর রহমান।
সাকিবের বোলিং মনে ঘাই মারতে পারে। এই সিরিজে বোলার সাকিব খুব ভালো করেননি আবার খারাপও করেননি (৩ ম্যাচে ২ উইকেট, ইকোনমি ৫.১১)। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৬৯ ম্যাচে সাকিবের উইকেটসংখ্যা ১১২। এই সময়ের পরিসংখ্যানে বোলার সাকিবই সবার ওপরে। আর ব্যাটিংয়ে এই সময়ে বাংলাদেশ দলের মোট ১৭ হাজার ৯৮৯ রানের মধ্যে ৯৮৪৫ রানই তামিম-সাকিব-মাহমুদউল্লাহর। ৫৪ শতাংশ রান এসেছে এই ‘চতুষ্টয়’-এর ব্যাট থেকে।
প্রতিশ্রুতি ভাঙলে গড়ে দিতে হয়। তরুণেরা সেই কাজটি যেহেতু করতে পারছে না তাই পাল্টায়নি সমর্থকদের আস্থার জায়গা। দল যেমন-ই করুক, ঘুরে ফিরে ‘শূলে’ কিংবা ভালোবাসার বেদিতে সেই পাঁচজনই। সমর্থকদের-ই বা কী দোষ, ভালোবাসার সঙ্গে শুধু আস্থাভাজনদেরই যে ‘বকুনি’ দেওয়ার অধিকার খাটে। আর তাই আমাদের ক্রিকেট ক্যানভাসে বাস্তব কিংবা কল্পনার ছবি তুলি সেই পাঁচটাই।