মাশরাফি ম্যাজিকে দাপুটে জয়ে চেনারূপে বাংলাদেশ

ধীরস্থির শুরুর পর মারকুটে শেষ টেনেছিলেন ব্যাটসম্যানরা। সেই ভিতে তৈরি হওয়া মঞ্চে বোলাররা শুরু থেকেই থাকলেন আত্মবিশ্বাসী। নিয়মিত বিরতিতে তুলে নিলেন উইকেট। তাতে টেস্টের দুঃস্বপ্ন পেছনে ঠেলে ৪৮ রানের দুর্দান্ত জয়েই তিন ওয়ানডের সিরিজ শুরু করেছে বাংলাদেশ।

রোববার গায়ানায় শুরুতে ব্যাট করে তামিম-সাকিবের রেকর্ড জুটিতে নির্ধারিত ওভারে ৪ উইকেটে ২৭৯ রানের পুঁজি জমা করে বাংলাদেশ। যেটি স্বাগতিকদের মাটিতে বাংলাদেশের সেরা সংগ্রহ। জবাব দিতে নেমে ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৩১ রানের বেশি এগোতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

টেস্ট সিরিজে হারের ক্ষতের সঙ্গে দৃষ্টিকটু ব্যাটিং সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওয়ানডে সিরিজে শুরুর ব্যাটিং সেটিতে বাড়তি সমালোচনার খোরাক যোগানোর আভাস দিচ্ছিল। টস জিতে ব্যাটিং নেয়ার পর শুরুতেই সাজঘরে বিজয়, রানের খাতা খোলার আগেই।

তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের ব্যাট লড়াইয়ের শুরুটা করে সেখান থেকেই। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে জুটি বেধে শেষঅবধি যখন বিচ্ছিন্ন হলেন, দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের রেকর্ড জুটি ততক্ষণে ২০৭ রানে পৌঁছে গেছে। জুটি বেধে দ্বিশতক রান তোলার বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঘটনা যেটি।

পথে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের দশম সেঞ্চুরি পূর্ণ করা তামিম খেলেন ১৩০ রানের অপরাজিত ইনিংস। যাতে ১০ চারের সঙ্গে ৩ ছক্কার মার, খেলেছেন ১৬০ বল। ১৪৬ বলে শতক ছোঁয়ার ঘটনা অবশ্য তাকে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের স্লথ সেঞ্চুরির রেকর্ডের পাশে বসিয়ে দিয়েছে।

সেখানে ৩ রানের জন্য সেঞ্চুরি বঞ্চিত হয়েছেন সাকিব। এ বাঁহাতি ৯৭ রান করে বিশুর বলে মিডউইকেটে ক্যাচ দিলে ভাঙে রেকর্ড জুটিটি। সাকিবের ইনিংস ১২১ বলের, ৬টি চার থাকলেও কোনো ছক্কা নেই।

দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। আগের সর্বোচ্চ জুটিটি ছিল ইমরুল কায়েস ও জুনায়েদ সিদ্দিকীর। ২০১০ সালে ডাম্বুলায় পাকিস্তানের বিপক্ষে তোলা ১৬০ রান।

তামিম-সাকিবের নতুন জুটিটি যেকোনো উইকেটেই দেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। গত বছর কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ পঞ্চম উইকেট জুটিতে তুলেছিলেন ২২৪ রান।

এটি আবার ওয়ানডেতে ৩০বার একসঙ্গে ব্যাট করা সাকিব-তামিমেরও সর্বোচ্চ জুটি। তারা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ডাম্বুলায় গত বছর জুটি বেধে ১৪৪ রান তুলেছিলেন, সেটিই টপকে গেলেন।

দুই অভিজ্ঞ সিনিয়র নিজেদের কাজটা করে দিয়েছেন। তবে বোলারদের নির্ভার রাখতে শেষদিকে বাড়তি কিছু রান আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। মুশফিকুর রহিম ছোটখাটো ঝড়ে সেটাই এনে দেন।

সাকিবের বিদায়ের পর যখন দ্রুতই ফিরে যান সাব্বির (৩), তখন ঝড় তোলেন মুশফিক। ১১ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় করেন ৩০ রান। আর শেষ বলে চার মেরে বাংলাদেশের ইনিংসে সমাপ্তি টানেন মাহমুদউল্লাহ।

তাতে বোলাররা কেবল লড়াইয়ের পুঁজিই পাননি, আত্মবিশ্বাসের পারদও চড়িয়ে নেন। পরে কাজেও লাগিয়েছেন ভালোমতোই। শুরুটা করেন অধিনায়ক মাশরাফী। ক্রিজে জমে যাওয়ার আগেই বিপজ্জনক এভিন লুইসকে সাজঘরে পাঠান।

দুই প্রান্তে আঁটসাঁট বোলিংয়ের ফাঁস কেটে বেড়োতে চেয়েছিলেন স্বাগতিক ওপেনার। উড়িয়ে মারতে যেয়ে টাইমিং করতে পারেননি লুইস (১৭), লংঅফে এ বাঁহাতির ক্যাচ লুফে নেন আগের ওভারেই বাজে ফিল্ডিংয়ে চার রান দেয়া মাহমুদউল্লাহ।

প্রথম ১০ ওভারে ওই এক সাফল্যই। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩১ রানের বেশি তুলতে পারেনি। যদিও ক্রিজে ছিলেন ক্রিস গেইল। অবশ্য মিরাজের করা ১২তম ওভারের শেষ বলে রিভিউ নিলে গেইলের উইকেট পেয়ে যেত বাংলাদেশ। জোড়াল আপিল করলেও রিভিউ নেয়নি সফরকারীরা।

পরের ওভারে শাই হোপকে (৬) ফিরিয়ে সেই দুঃখ কিছুটা কমান রুবেল হোসেন। ১৩তম ওভারে বোলিংয়ে এসেই আঘাত হানেন এ পেসার। হোপকে এলবিডব্লিউ করেন।

বিপজ্জনক গেইল তখনও ছিলেন। ধীরস্থির হয়ে বিপদের আভাসই দিচ্ছিলেন। রানআউটে যার সমাপ্তি আসে। মোসাদ্দেকের বল শর্ট থার্ডম্যানে ঠেলে শিমরন হেটমায়ার রানটা নিতে চাননি। কিন্তু গেইল অনেকটা পথ এগিয়ে যান। মাহমুদউল্লাহ বল ধরে থ্রো করেন, মোসাদ্দেক বাকি কাজটুকু সেরে ৬০ বলে এক চার ও দুই ছক্কায় ৪০ রান করা গেইলকে সাজঘরের পথ ধরান।

পরের আঘাত মিরাজের। সেসময় ১০ রান করা জেসন মোহাম্মেদের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে আসা বল গ্লাভসে জমা করেন মুশফিক। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারানোর মাঝেই একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যান হেটমায়ার। তাকে ফেরানোর কাজটা করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

উইকেট আসে বাঁহাতি পেসারে চেনাঅস্ত্র কাটারে। অফস্টাম্পের বাইরের কাটার বুঝতে না পেরে ক্যাচ তুলে দেন ৭৮ বলে ৫২ রান করা হেটমায়ার। পরের বলেই রোভম্যান পাওয়ালকে তুলে নেন ফিজ। গোল্ডেন ডাকের স্বাদ দিয়ে ফেরানো পাওয়েলকেও মুশফিকের ক্যাচ বানান। অবশ্য হ্যাটট্রিক তুলে নিতে পারেননি। সেটি ঠেকিয়ে দেন আন্দ্রে রাসেল।

পরের গল্পটুকু অধিনায়ক মাশরাফীর। যার শুরুটা জেসন হোল্ডারকে দিয়ে। মাশরাফীর আগের বলেই লংঅন দিয়ে বিশাল ছয় হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক, টাইগার অধিনায়ক পরের বলে স্লোয়ারে শোধ নেন। হোল্ডার (১৭) মোসাদ্দেকের তালুবন্দী।

জয়ের গন্ধ ততক্ষণে পেতে শুরু করেছে বাংলাদশ। সেটাতে বাগড়া দিতে প্রস্তুত হন অলরাউন্ডার রাসেল। মোস্তাফিজকে চার-ছয় হাঁকিয়ে জানান দেন পাল্টা লড়াইয়ের। সেটি দীর্ঘ হতে দেননি মাশরাফী। দারুণ আরেকটি স্লোয়ারে লংঅনে মাহমুদউল্লাহকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন ম্যাশ। ১২ বলে ১৩ রানেই বিরতি রাসেলের।

মাশরাফী তখনও বিরতি নেননি। নিজের দশম ওভারে কোটা পূর্ণ করতে এসে অ্যাশলে নার্সকেও মাহমুদউল্লাহর ক্যাচ বানান। এক মেডেনসহ ৩৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে দিনের সেরা অভিজ্ঞ পেসারই।

দারুণ বল করা মাশরাফী ও মিরাজের ওভার তখন শেষ। অফস্পিনার মিরাজও ১০ ওভারে ৩৭ রান দিয়েছেন, ঝুলিতে এক উইকেট। তখন বাকিদের ওপর চড়াও হয়ে বসেন দেবেন্দ্র বিশু ও আলজারি জোসেপ। অবশ্য পরাজয়ের ব্যবধান কমানো ছাড়া আর কোনো কাজে আসেনি তাদের শেষের প্রতিরোধ। বিশু ও জোসেপ দুজনেই ২৯ রান করে তুলে অপরাজিত থাকেন।