দু’হাজার পনেরো সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল স্টিভ ওয়ারেন এক ঘোষণায় বলেছিলেন, ইরাক এবং সিরিয়ায় এক অভিযান চালিয়ে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর প্রায় ১০ জন ঊর্ধ্বতন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।নিহতদের একজন ছিলেন সাইফুল সুজন – একজন বাংলাদেশী নাগরিক – যিনি ১০ই ডিসেম্বর সিরিয়ার রাক্কার কাছে নিহত হন।অপারেশন ‘ইনহেরেন্ট রিজল্ভ’ নামের ওই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু যারা ছিলেন – তাদের অনেকেই নিহত হন ড্রোন আক্রমণে। কর্নেল ওয়ারেন তখন বলেছিলেন, তারা ‘সাপের মাথায় আঘাত করছেন’ এবং আইসিসের নেতাদের হত্যা করছেন।
সাইফুল সুজন সম্পর্কে তিনি বলেন, “সুজন একজন বহির্দেশীয় কার্যক্রমের পরিকল্পনাকারী ছিলেন, এবং ব্রিটেনে কম্পিউটার সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। “তিনি আরো বলেন, আইএসের হ্যাকিং কার্যক্রম, নজরদারি এড়ানোর প্রযুক্তি, এবং অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে একজন মূল ব্যক্তি ছিলেন এই সুজন।
বলা হয়, সুজন মারা যাওয়াতে আইসিস আর নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে।এই মূল্যায়নে বোঝা যায়, আইএসের একটি প্রভাবশালী সেলের নেতা ছিলেন এই বাংলাদেশী।তার মৃত্যুর পর কয়েক মাস ধরে এবং তিনটি মহাদেশে এক ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে বিবিসি ওয়েলস।
বিবিসি ওয়েলস জানতে পেরেছে যে, সুজন নিহত হবার পরও তার নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য অর্থায়ন করে চলেছে – এমন দাবি করছেন অনেকে।অনুসন্ধানে আরো বেরিয়ে এসেছে যে সুজন কীভাবে আইএসের একজন মূল ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।সুজন বাংলাদেশ থেকে ২০০০ সালে ব্রিটেনে আসেন। তার চেহারা বা ব্যক্তিত্বে এমন কিছুই ছিল না যাতে মনে হতে পারে যে এক দশকেরও কম সময়ে তিনি আইএসের অন্যতম ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিতে পরিণত হবেন।
কার্ডিফের উত্তরে পন্টিপ্রিডে সাবেক গ্ল্যামরগ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন।সে সময় ২০০৫ সালে তার সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে রব রিসের। রব রিসের বাড়িটি কিনতে চেয়েছিলেন সুজন। তার মনে আছে, সুজন ছিলেন একজন শান্ত এবং কর্মঠ লোক, তবে তার হাতে তেমন টাকা-পয়সা ছিল না।
তার স্ত্রীর সে সময়ই বাংলাদেশ থেকে আসার কথা, এবং তার জন্য তিনি একটি বাড়ি কিনতে চাইছিলেন, কিন্তু ব্যাংকের ঋণ নেবার জন্য যে ডিপোজিট তা কোনমতে যোগাড় করেছিলেন তিনি।রিস বলছিলেন, তার কাছে মনে হয়েছিল সুজন যেন কি করবেন তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না।
কিন্তু কয়েক বছরে মধ্যেই সুজনের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। তিনি আইব্যাকস নামে তার নিজের একটি আইটি কোম্পানি খোলেন, ওয়েলস বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সে যোগ দেন, অন্য ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে বাংলাদেশ সফরও করেন।এক পর্যায়ে সুজনের ভাই আতাউল হকও ওয়েলসে চলে আসেন তার সঙ্গে থাকতে, এবং দুজনে মিলে তাদের ব্যবসা চালাতে থাকেন। তাদের কোম্পানিটি মূলত এশিয়ান খাবার দোকানগুলোর জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করতো, বিভিন্ন দক্ষিণ এশীয় রেস্তোরাঁর জন্য বিল পরিশোধ করার মেশিন চীন থেকে আমদানি করে সরবরাহ করতো। তাদের ব্যবসায় পার্টনার না হয়েও জড়িত ছিলেন আরেকজন – যার নাম আবদুল সামাদ।
আবদুল সামাদও বাংলাদেশী পরিবারের সন্তান – কিন্তু তার জন্ম এবং লেখাপড়া ওয়েলসেই। তিনিও ছিলেন একজন স্থানীয় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ -এবং সুজনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এটা এমন এক সময় যখন ব্রিটেনের অন্য অনেক শহরের মতো কার্ডিফেও উগ্রপন্থায় দীক্ষিত মুসলিম তরুণদের নিয়ে এক সমস্যা তৈরি হয়। এরা ছিলেন বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটেনে আসা পরিবারের সন্তান। তরা বৈশ্বিক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং ইসলামিক স্টেটের বিকৃত ও গোঁড়া ব্যাখ্যার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন।
কার্ডিফ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক জিহাদের ‘পোস্টার বয়ে’ পরিণত হয়েছিলেন নাসের মুথানা, আর রেয়াদ খান।তাদেরকে দেখা গেল আইএসের ভিডিওতে উপস্থিত হয়ে ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত আইসিসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে।কার্ডিফের বাংলাদেশী কমিউনিটির চোখে সুজন ধর্মীয় দিক থেকে তেমন রক্ষণশীল ছিলেন না, তার কথাবার্তাতেও জিহাদি-সমর্থক ইসলামী প্রচারকদের মত কোন কিছু শোনা যায় নি।
“সে মোটেও ধার্মিক ছিল না, ব্যবসা এবং অর্থ আয়ের দিকেই তার ঝোঁক ছিল, তার বিয়েতেও নারী-পুরুষকে আলাদা রাখার মতো রক্ষণশীল কিছু ছিল না” – বলছিলেন কার্ডিফের এক রেস্তোরাঁ মালিক এনামউজ্জামান -যার সাথে সুজনের কিছু ব্যবসায়িক লেনদেন হয়েছিল।
তবে এক পর্যায়ে সুজনের চেহারায় কিছু পরিবর্তন এলো, পরিষ্কার করে দাড়িগোঁফ কামানো পশ্চিমা ধাঁচের চেহারা বদলে গিয়ে তাকে একজন ধার্মিক বাংলাদেশী মুসলিমের ঐতিহ্যবাহী দাড়িওয়ালা চেহারা নিতে দেখা গেল – বলেছেন তার কাজের জায়গায় তাকে দেখেছেন এমন কয়েকজন।কিন্তু সেই পরিবর্তনকে উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হবার চিহ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কাজেই তার মনে এরকম পরিবর্তন এসে থাকলেও তিনি হয়তো সেটা বাইরে প্রকাশ করেন নি।
সাইফুল সুজন এবং আতাউল হক বিয়ে করেছিলেন দুই যমজ বোনকে। তাদেরকে তারা ব্রিটেনে নিয়ে এসেছিলেন। তবে ২০১২ সালে সুজনের ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাবার পর তার জীবনের গতিপথ বদলে যায় বলে তার পরিচিতরা বলেছেন। তিনি একজন উচ্চাভিলাষী পশ্চিমা ব্যবসায়ী থেকে পরিণত হন উগ্র-ইসলামপন্থীদের সমর্থক অর্থদাতা এবং যন্ত্র-সামগ্রী সরবরাহকারীতে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাস-দমন কর্মকর্তারা এসব বিষয় জানতে পারেন অনেক পরে।কোথায় এবং কিভাবে আইএস নেতা হিসেবে সুজনের কর্মকাণ্ড প্রথম ধরা পড়েছিল – তা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর শহরে যান বিবিসি ওয়েলসের সংবাদদাতা ওয়াইর ডেভিস।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে গড়ে ওঠা জঙ্গি তৎপরতার ওপরও অনেক দিন ধরেই তদন্তকারীদের নজর ছিল। এদের অনেকে জিহাদে যোগ দিতে মধ্যপ্রাচ্যে গেছে, অনেকে ফোর্ট হুড হত্যাকান্ড বা বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলার মতো ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মূলভুমিতেই ঘটিয়েছে। কিন্তু এফবিআই এবং অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কার্যকর নজরদারির কারণে সন্ত্রাসী আক্রমণে সরাসরি বিদেশী অর্থায়ন হতে পারে নি। তবে ২০১৫ সালে একটা ঘটনা ঘটলো – যা অন্য রকম।বাড়ি বাড়ি সংবাদপত্র পৌঁছে দেন – এমন একজন লোকের ওপর এফবিআইয়ের নজর পড়লো।
বাল্টিমোরের বাসিন্দা মোহামেদ এলশিনাবির কাছে নিয়মিতভাবেই ছোট অংকের অর্থ আসতো ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রাম হয়ে – এক হাজার বা পাঁচশো ডলার, এরকম অংকের। কিন্তু ২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালে একবার পাঠানো হলো আট হাজার ডলার।অক্টোবর মাস নাগাদ ফেডারেল এজেন্টরা পদক্ষেপ নিলেন। তারা এলশিনাবির বাড়ি তল্লাশি করলেন, এবং সেখানে তারা পেলেন সুজনের কার্ডিফ-ভিত্তিক কোম্পানির সাথে যোগাযোগের প্রমাণ।কিছুদিনের মধ্যেই তারা আরো বের করলেন, এই অর্থ আসছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সন্ত্রাসী আক্রমণ চালানোর জন্য। শুধু অর্থ নয়, কিভাবে আক্রমণ চালাতে হবে তার পর্যায়ক্রমিক নির্দেশনাও পাঠানো হচ্ছিল – ওয়েলসের আইব্যাকস এ্যাকাউন্ট থেকে।
এলশিনাবির কেস এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফলো করছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমাস হিউজ। তিনি বলেন, “এসব ব্যক্তিরা আক্রমণ চালানোর জন্যে এলশিনাবিকে নির্দেশনা দিচ্ছিল।”তার অফিসের দেওয়ালে মাকড়সার জালের মতো একটি নকশা আঁকা আছে, সেখানে আছে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ছবি- তাদের কেউ আজ জীবিত আবার কেউ মৃত। এটা থেকে বোঝা যায় তার অনুসন্ধান কতোটা জটিল।
“প্রথম যোগাযোগ ছিল টেক্সাসে এক ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশনা,” বলেন মি. হিউজ, “কিন্তু এলশিনাবি যখন সবকিছু একসাথে পাচ্ছিল না, তারা বললো ‘তাহলে তোমরা কেন বাল্টিমোরে বড় ধরনের হামলা চালানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছ না?”
এলশিনাবিকে সুজন কমপক্ষে ১৬টি ভিডিও পাঠিয়েছে যাতে কীভাবে বোমা বানাতে হয় তার নির্দেশনা রয়েছে। এফবিআই-এর তদন্তকারী কর্মকর্তারাও দেখেছেন যে যেসব লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যেতে পারে এরকম কিছু স্থাপনা এলশিনাবি গবেষণা করে দেখেছে। তার মধ্যে রয়েছে বাল্টিমোরে ফেডারেল কোর্টের ভবনও।তার বিরুদ্ধে যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে সেসব দেখে মোহাম্মদ এলশিনাবি তার বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাসবাদের কয়েকটি অভিযোগ সে স্বীকার করেছে। এবছরের শুরুর দিকে আদালত তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সন্ত্রাসী হয়ে উঠতে পারতো এরকম একজন ব্যক্তি এই এলশিনাবি। তিনি এখন কারাগারে আটক বলে হয়তো নিরাপদ। কিন্তু মি. হিউজ বলছেন, তার গবেষণা থেকে এটা বোঝা গেছে যে আইএসের নেটওয়ার্ক কতোটা দক্ষ, যার মাধ্যমে তাকে রিক্রুট করা হয়েছিল। এটা এমন একটা নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে দক্ষিণ ওয়েলসের একটি আইটি ফার্মকেও যুক্ত করা হয়েছিল।
“এই নেটওয়ার্কের দক্ষতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বেশিরভাগ বিশ্লেষকই সেটা ধারণা করতে পারেন নি,” বলেন মি. হিউজ। তারা এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাঠাতো যাতে কেউ সন্দেহ না করে। এটা অভিনব। যুক্তরাষ্ট্রে আইসিসের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র এই অর্থায়নের ব্যাপারেই জানা গেছে।”
মি হিউজের কোন সন্দেহ নেই যে সুজন এবং তার সহযোগীরা মিলে যে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল এলশিনাবির ঘটনা তার মুখ খুলে দিয়েছে।তারা এফবিআই-এর বহু তথ্য, আদালতের বহু কাগজপত্র খতিয়ে দেখেছেন। সেখানে দেখা গেছে সুজন আইএসের অর্থায়নের লক্ষ্যে এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠাতে কতোটা ব্যাপক মাত্রায় কাজ করতো।
এফবিআই-এর কাগজপত্রে দুটো নাম ঘুরে ফিরে এসেছে- আতাউল হক এবং সুজনের ভাই আব্দুল সামাদ।এফবিআই বলছে, তাদের তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে মি. সামাদ আইএসকে সমর্থন করতেন। এবং সুজনের নির্দেশে তিনি আমেরিকায় এলশিনাবির কাছে ব্যক্তিগতভাবে অর্থ পাঠিয়েছিলেন।আরো দেখা গেছে যে তিনি আইএসের জন্যে কারিগরি যন্ত্রপাতিও সংগ্রহ করতেন।এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে- সামরিক ধরনের নজরদারি যন্ত্রপাতি এবং ড্রোনের বিভিন্ন অংশ সংগ্রহের ব্যাপারে সুজন একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। এগুলো পাঠানো হতো তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় এবং ইরাকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের কাছে।
এফবিআই-এর কাগজপত্রে এই একটি উদাহরণে দেখা যায়, উত্তর আমেরিকার সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ১৮ হাজার ডলার অর্থমূল্যের নজরদারি যন্ত্রপাতি সংগ্রহে মি. সামাদ কতোটা সরাসরি যুক্ত ছিল। এসব করা হয়েছে সুজনের অনুরোধে। পরে সেগুলো পাঠানো হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।এফবিআই-এর তদন্তকারী কর্মকর্তারা বারবার এটা দেখিয়েছেন যে এসব যন্ত্রপাতির কোনটাই আইব্যাকসের ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।
অর্থ ও যন্ত্রপাতি প্রেরণের সাথে মি. সামাদের সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে গিয়ে কর্মকর্তারা বিভিন্ন জনের সাথে তার যোগাযোগের গভীরে চলে যান। সোশাল মিডিয়াতে তার ইতিহাসও খতিয়ে দেখেন।আমরাও এমন কিছু তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি যা থেকে মি. সামাদ যে আইএস এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী আদর্শের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন এফবিআই-এর এই দাবির সাথে মিল পাওয়া গেছে।
‘কিলওবামা৭৭’
তিনি আইএসের প্রচারণাধর্মী ভিডিও শেয়ার করেছেন যেখানে ধারাভাষ্যকার ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। অন্যান্য ভিডিওগুলোতে মুসলিমদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে রণক্ষেত্রে গিয়ে শহীদ হওয়ার জন্যে।আল কায়দার কুখ্যাত এবং শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে তিনি ‘একবিংশ শতাব্দীর আদর্শ চরিত্র’ বলেও উল্লেখ করেছেন।তার একটি অফিস অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ছিল কিলওবামা৭৭।
যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ মি. সামাদকে গ্রেফতার করে ২০১৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর। সেদিনই সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত হন সুজন।ততোদিনে কার্ডিফে আইব্যাক অফিসের একক দখলদারে পরিণত হন সুজন। সেখান থেকে বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই জব্দ করা হয়।পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনার জন্যে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তখন মি. সামাদের কাছে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আইএসের একজন সমর্থকের কাছে অর্থ পাঠাতে সাহায্য করেছেন, তিনি জড়িত ছিলেন উচ্চমানের সামরিক প্রযুক্তি সংগ্রহের সাথে। আইএসের ব্যবহারের জন্যে এসব সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছিল। তিনি ইসলামী চরমপন্থার একজন সমর্থক- এফবিআই-এর এই দাবীর পক্ষেও তার কম্পিউটারে ভিডিওসহ আরো কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেছে।
জবাবে মি. সামাদ জানিয়েছেন তাকে গ্রেফতার করার পর তাকে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল কোন ধরনের অভিযোগ ছাড়াই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয়নি।
খারাপ কোন কিছু করার সাথে জড়িত থাকার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তিনি চরমপন্থায় বিশ্বাসী নন এবং যুক্তরাষ্ট্রে হামলার ব্যাপারে অর্থায়ন সম্পর্কেও তার কোন ধারণা নেই। তিনি দাবি করেছেন, তার কোম্পানির জন্যে শুধুমাত্র বৈধ জিনিসপত্র কেনার ব্যাপারেই তিনি অর্ডার করেছিলেন।
মি. সামাদের কাছে আরো একটি নতুন অভিযোগের বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়। অভিযোগটি হচ্ছে- ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি দক্ষিণ ওয়েলসে নতুন একটি কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন। এই কোম্পানি তৈরি করা হয়েছিল সুজনের ভাই আতাউল হকের জন্যে যিনি সেসময় স্পেনে কাজ করতেন এবং সেখানেই বসবাস করতেন।হক সুজনের এক বছরের বড়। তারা খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। আইব্যাকস ব্যবসাতেও তারা ছিল অংশীদার।
বাল্টিমোরে আইএসের সমর্থক মোহাম্মদ এলশিনাবির বিরুদ্ধে এফবিআই যে মামলা করেছে, সেখানে সুজনের ভাই হকের নামও ভালোভাবেই উল্লেখ করা আছে, যেমনটা আছে মি. সামাদের কথাও।এও দেখা গেছে, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে থাকা সত্ত্বেও হকের বিরুদ্ধে কখনো কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আইএসের একজন সিনিয়র নেতা সুজনের ভাই এবং তাদের কোম্পানির একজন পরিচালক হওয়ার পরেও তাকে কখনো গ্রেফতার করা হয়নি।
তার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কার্ডিফে একজন স্পেনিশ মহিলার সাথে তার পরিচয় হয়। পরে তারা বিয়ে করেন এবং তার সূত্র ধরেই মি. হক স্পেনে চলে যেতে সক্ষম হন।তুরস্ক থেকে মি. হককে ফেরত পাঠানোর পর তারা ২০১৫ সালের অগাস্ট মাসে স্পেনে থিতু হন।তবে শুরু থেকেই স্পেনিশ পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন মি. হক। পরে তার বিষয়ে তদন্তের সময় মাদ্রিদে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুজনের মৃত্যুর পরেও আইএসের নেটওয়ার্ক কীভাবে সক্রিয় ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মি. হক স্পেনে কিছুটা ভিন্ন নামে কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এই নামটা ছিল ইজিনটেল। তার ভাই সুজনও এর আগে দক্ষিণ ওয়েলসে প্রায় একই ধরনের একটি আইটি কোম্পানি পরিচালনা করতো।”আমরা জানতাম যে তার ভাই আইসিসের একজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি ছিল। বাইরে থেকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আইনসম্মতই ছিল কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল আইসিসকে প্রযুক্তি ও অর্থের যোগান দেওয়া,” বলেন তিনি।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্পেনিশ পুলিশের কাছে হককে তার ভাই সুজনের চেয়েও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হয়েছে। বিশেষ করে আইএসের জন্যে ড্রোন সংগ্রহের ব্যাপারে।গত বছর ইরাকে মসুলের যুদ্ধের সময় আইএস ড্রোন ব্যবহার করে মর্টার ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। আত্মঘাতী হামলাকারীদের পরিচালনা করতেও এই ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নেওয়ার কারণে আমেরিকানরা ২০১৫ সালের শেষের দিকে সুজনকে টার্গেট করেছিল।কিন্তু স্পেনের পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, এসব ড্রোন সংগ্রহ করা এবং ব্যবহারের ব্যাপারে হকেরও বিশেষ আগ্রহ ছিল।”আইসিসের কী ধরনের ড্রোন দরকার সেবিষয়ে আতাউল বিস্তারিত গবেষণা চালিয়েছে। জানার চেষ্টা করেছে স্পেনের বাজারে কী ধরনের ড্রোন আছে,” বলেন একজন স্পেনিশ কর্মকর্তা। যদিও তারা জানতো যে আইব্যাকস নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যে এমনকিছু সামরিক যন্ত্রপাতি যা বিভিন্ন কাজের জন্যে ব্যবহার করা যায়, সেগুলো আইসিসের কাছে প্রেরণ করেছে।
আমেরিকায় একজন সামরিক বিশ্লেষক পিটার সিঙ্গার বলেছেন, “সন্ত্রাসীরা আরো বেশি ড্রোন ব্যবহার করবে শুধু একারণে নয় যে তারা ইরাক অথবা সিরিয়াতে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। তারা আরো বেশি ড্রোন ব্যবহার করবে কারণ এই প্রযুক্তি দিনে দিনে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।”
স্পেনের পুলিশ দাবি করেছে, সুজনেরও আগে তার ভাই হক আইসিসের প্রভাব বলয় বাড়াতে তৎপর ছিল।”তুরস্কে প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা সে-ই করেছিল। বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের কাছেও পাঠিয়েছিল হাজার হাজার ডলার,” বলেছেন মাদ্রিদের একজন পুলিশ অফিসার।
তিনি বলেন, “আমাদের হিসাব হচ্ছে আতাউল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে মোট ৫০ হাজার ডলার পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশে আমাদের সহকর্মীরা জানিয়েছেন এসব অর্থ প্রেরণের লক্ষ্য ছিল সেখানে হামলা চালানো।”
বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ সেদেশে আইএসের উপস্থিতির কথা মানতে রাজি নয়, যদিও দেশটিতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং বহু সংখ্যক বাংলাদেশি জিহাদি আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে ইরাক ও সিরিয়াতে চলে গেছে।
বাংলাদেশী একজন সাংবাদিক তাসনিম খলিল মনে করেন, বাংলাদেশে আইএসের প্রভাব বৃদ্ধির ব্যাপারে সুজন এবং তার নেটওয়ার্কের বড় রকমের ভূমিকা আছে।এই দুই ভাই-এর প্রভাব নিয়ে বহু বছর ধরে রিপোর্টিং করছেন তিনি। তাসনিম খলিল বলেছেন, তার এধরনের কিছু কাজের জন্যে বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ তাকে নির্যাতন করেছে এবং সেকারণে তিনি সুইডেনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন।
“সারাবিশ্বে আইএসের অর্থায়নের পেছনে একটা বড় ভূমিকা আছে সাইফুল সুজনের। তিনি বাংলাদেশে আইসিসের প্রাথমিক কিছু তৎপরতা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে কিছু তরুণ সংগ্রহ করে তাদেরকে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেন,” বলেন তিনি।
মি. খলিলের ধারণা সুজনের এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, প্রাথমিকভাবে কার্ডিফের কোম্পানি এবং পরে বাংলাদেশে তাদের কিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অন্তত ৫০ জন জিহাদিকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের অর্ধেক ইরাক অথবা সিরিয়াতে চলে গেছে। আর বাকিরা সম্ভবত বাংলাদেশের ভেতরেই হামলা চালিয়েছে।তার মতে, এসব হামলার পেছনে সুজনের অর্থেরও যোগান থাকতে পারে।
সন্ত্রাসী হামলা
এও ধারণা করা হয় যে ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পেছনেও সুজনের প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্কের আর্থিক সহযোগিতা থাকতে পারে। ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিল।এবিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ।সুজনের মৃত্যুর প্রায় দু’বছর পর স্পেন ও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় তারা তার প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক, যা এখনও সক্রিয় আছে, সেটি ভেঙে দিতে কাজ করবে।
দক্ষিণ স্পেনের মেরিদা শহর থেকে হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সাথে চালানো অভিযানে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে বাংলাদেশেও ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।স্পেনের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কোন সন্দেহ নেই যে হক এবং তার ভাই সুজন তারা দুজনেই খুব বিপজ্জনক ব্যক্তি।
“যারা প্রকাশ্যে হামলার হুমকি দেয়, তাদের চাইতেও তারা ভয়ঙ্কর। ওদেরকে সহজে মোকাবেলা করা যায় কিন্তু চারটি দেশের একসাথে হয়ে এই দুই ভাই-এর নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে ছয় বছর সময় লেগেছে,” বলেন একজন কর্মকর্তা।আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সারা বিশ্বের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এসব অর্থ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহকারীরা এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যাতে তারা দেশে বিদেশে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নতুন নতুন জিহাদি সংগ্রহ করতে না পারে।
বাল্টিমোরে মি. লরমেল বলেছেন, সন্ত্রাসীদের অর্থদাতারাও এখন সন্ত্রাসীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।”তাদের অর্থের প্রবাহ যতো কমিয়ে দেওয়া যাবে, ততোই তাদের হামলার ঘটনা কমে যাবে,” বলেন তিনি।সাইফুল সুজন ড্রোন হামলায় মারা গেছে।
আতাউল হক আছেন স্পেনের জেলে। পুলিশ বলছে, তার বিরুদ্ধে এখন সন্ত্রাসমূলক অপরাধের অভিযোগ আনা হতে পারে, যদিও তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।আবদুল সামাদও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সবশেষে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেবিষয়ে তিনি কিছু বলেন নি। অভিযোগ হচ্ছে, তিনি মি. হকের জন্যে ওয়েলসে নতুন একটি কোম্পানি তৈরি করেছেন। এই কোম্পানির নাম ইজিনটেল। এই একই নামে স্পেনেও একটি কোম্পানি আছে। স্পেনের পুলিশ বলছে, আইএসের অর্থায়নে এই কোম্পানির বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।
সুজনের গড়ে তোলা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক হয়তো শেষ পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে তার মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার দুই বছরেরও বেশি সময় পর এখনও এটা বলা সম্ভব নয় যে সন্ত্রাসী হামলার জন্যে জিহাদিদের অর্থায়ন বন্ধ করা কতোটা সম্ভব হয়েছে।