রাজনীতির বিশ্বকাপ পুতিনের হাতেই!

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসো মে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে ঘোষণা দিয়েছেন সরকারের কোনো মন্ত্রী বা কূটনীতিক রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠানে যোগ দেবে না। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ৬০ জন সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের উদ্দেশে এক চিঠি লেখেন। সেখানে যুক্তরাজ্যের বিশ্বকাপ বয়কটের সিদ্ধান্তে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। জার্মানির চ্যান্সেলর ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টও ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদি তাদের দেশ ফাইনালে খেলে, শুধু তখনই তারা রাশিয়ায় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানে যাবেন।

গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ একশ জনের মতো রাশান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। এসব পদক্ষেপ রাশিয়ার সাবেক সামরিক কর্মকতা ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়েকে খোদ যুক্তরাজ্যে বিষপ্রয়োগে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে নেওয়া। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন টানাপোড়েনের মধ্যে রাশিয়ায় বসে বিশ্বকাপ ফুটবলের ২১তম আসর। এবার বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের চিরচেনা বর্ণিল সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল; কিন্তু সমস্ত আশঙ্কার মুখে ছাই ঢেলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন সারাবিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন। শুধু রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশেই তিনি সেরা নন, প্রতিকূল অবস্থায়ও বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্ খেলাধুলাবিষয়ক আসরটি সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে পারেন।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে ফিফার এক কংগ্রেসে পুতিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাশিয়ায় অতিথিরা আন্তরিকতা ও দারুণ অর্ভ্যথনা পাবেন। তবে একটা বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, রাজনীতি দূরে রাখতে হবে। খেলাধুলার মূল যে নীতি- রাজনীতির বাইরে থাকবে খেলাধুলা-এটা সকলকে স্মরণ রাখতে হবে।

বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠান জাঁকঝমকপূর্ণ করতে দুই হাতে অর্থ ঢেলেছেন পুতিন। মোট ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। স্টেডিয়াম নির্মাণ ছাড়াও বিমানবন্দর ও দেশের ভেতরকার সড়ক-রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নসহ অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হয়েছে। দেশটির সচরাচর জটিল ও ব্যয়বহুল ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করা হয়েছে। বিশ্বকাপের টিকিটধারীদের ‘ফ্যান আইডি’ দেওয়া হয়েছে। যা ভিসা হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে।

রাশিয়ার গোঁড়া ভক্তদল ‘আলট্রাস’সহ অন্যান্য উগ্রবাদী ভক্তগ্রুপ যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে সেজন্য সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল। মাঠে গোলযোগ সৃষ্টির পুরনো রেকর্ড আছে এমন সাড়ে চারশ দর্শককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাশিয়ায় বিরোধীদলীয় লোকজনের ওপর দমন-পীড়ন ও বন্দি করে রাখার অভিযোগ ঘুচাতে ৭ জুলাই মুক্তি দেওয়া হয়েছে ২৫ দিন ধরে আটক বিরোধীদলীয় নেতা এলেকসেই নাভালনিকে।

এ বিষয়ে ফিফার মানবাধিকার বিষয়য়ক উপদেষ্টা আইনজীবী সিলভিয়া শেনক বলেন, যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী যা যা করা দরকার করেছে। মোট কথা রাশিয়া চায় দেশে এবং দেশের বাইরে একটি সুন্দর ভাবমূর্তি।

এই বিশ্বকাপে আনুমানিক প্রায় ২৫ লাখ টিকিট বিক্রি হয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি আবার রাশিয়ার বাইরের দর্শক। এমনকি ৩০ হাজারের মতো মার্কিন দর্শক খেলা উপভোগ করেছে। সম্প্রতি পুতিনের সঙ্গে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রশ্ন করেছেন, এতকিছুর মধ্যেও তিনি কীভাবে সফলভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের কর্মযজ্ঞ সামলেছেন। কেননা এই বিশ্বকাপে ভক্তদের মধ্যে সহিংসতা হয়নি। কোনো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাও ঘটেনি। বরং মস্কোসহ রাশিয়ার অন্যান্য বড় শহরের রাস্তাঘাটে দর্শকদের উত্সবমুখর চিত্র দেখা গেছে।

তবে পুতিন মুখে যতই বলুক খেলাধুলাকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে, বাস্তবে তিনি কিন্তু স্পোর্টিং ইভেন্ট আয়োজনের পাশাপাশি রাজনীতির খেলার ছক আঁকেন। ২০১৪ সালের সোচি শীতকালীন অলিম্পিক এর নজির। ৫১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সেবার চোখ ঝলসে দেওয়ারমতো জাঁকঝমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। এসময়ই তিনি ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা করেন। অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠান শেষের চারদিনের মাথায় পুতিন রাশিয়ার অচিহ্নিত পোশাকের বিশেষ বাহিনী ‘লিটল গ্রিন ম্যান’কে পাঠান ক্রিমিয়া উপদ্বীপে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে এপর্যন্ত প্রায় দশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরো দশ লক্ষাধিক। তাই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা পুতিনকে খেলাধুলার অনুষ্ঠানের আয়োজন শেষে আরো বেশি পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে দেখেন। যেন বিরাট কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য প্রস্তুত তিনি।

বিশ্বকাপের আগে থেকেই রাশিয়ার বেশ কিছু প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড ছিল। যেমন— আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, ক্রিমিয়া দখল অভিযান, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগের মধ্যেও তাকে সামরিক সহায়তা, যুক্তরাজ্যের ভেতরে নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করে গোয়েন্দা পিতা ও তার কন্যাকে হত্যারচেষ্টা, পূর্ব ইউক্রেনে মালয়েশিয়ার এয়ালাইন্সের ফ্লাইট ১৭ ভূপাতিত করা ইত্যাদি। তাই এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বে রাশিয়ার মর্যাদা বাড়ানোর পাশাপাশি পুতিন তার নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও অহমিকা প্রদর্শনের প্রকল্প হিসেবে নিয়েছেন।

এছাড়াও রাশিয়ার শ্লথ অর্থনীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে যে বাজে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারও প্রয়াস ছিল। সেজন্য বিশ্বকাপের পেছনে দেদারসে অর্থ ঢালতে দেখা গেছে পুতিনকে। ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে একটানা যে ক্ষমতা তিনি ভোগ করছেন তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বিরোধীদলসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন-পীড়নের মাধ্যমে তিনি রাশিয়ার সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের বিরতিহীন কাভারেজের সঙ্গে কৌশলে ভ্লাদিমির পুতিন নিজেকেও সংযুক্ত করেছেন। যা তার একধরনের প্রচ্ছন্ন প্রপাগান্ডার মতো কাজ করেছে। তিনি সাধারণ জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি অপরিহার্য।

তবে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের পরিচালক কেইট এলেন বলেন, বিশ্বকাপের বর্ণিল আয়োজন, সবধরনের আনন্দ-চঞ্চলপূর্ণ অবস্থারও বাইরে আমাদের রাশিয়ার ভেতরের প্রতিদিনকার কঠোর বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে। ভ্লাদিমির পুতিনের অভিপ্রায় সদ্য সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন গত মার্চেই আঁচ করেছিলেন। তিনি বলেন, পুতিন বিশ্বকাপের মহিমায় মহিমান্বিত হতে চাইছেন, যেমনটি চেয়েছিলেন এডলফ হিটলার ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিক আয়োজনের মধ্যদিয়ে। পুতিনের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত হার্মিটেজ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা বিল ব্রাউডার বলেন, এই বিশ্বকাপ আয়োজনে পুতিনের বিশাল দর্শনগত বিজয় হয়েছে।