এমবাপ্পেই তো আজ তাদের আরেক বিশ্বকাপ জয়ের বাজির ঘোড়া

ফ্রান্সের ফুটবলাকাশ সবচেয়ে তারা ঝলমলে ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ে। তাদের বিশ্বকাপ জয়ের রাতে। সবাই দেখেছে তা, সবাই জেনেছে। এর মাস ছয়েক পর যে আরেক উজ্জ্বল তারকার আবির্ভাব ঘটে যায় সবার অলক্ষ্যে। কেউ জানেনি, কেউ দেখেনি। ফরাসিদের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের ছয় মাস পর জন্ম নেওয়া সেই কিলিয়ান এমবাপ্পেই তো আজ তাদের আরেক বিশ্বকাপ জয়ের বাজির ঘোড়া।

এই ফ্রান্স দলে তারকার কমতি নেই। কোচ দিদিয়ের দেশম যাঁদের ২৩ সদস্যের স্কোয়াডে নেননি, তাঁদের দিয়েই আরেকটি দল তৈরি করা যায়! সে দলও খুব খারাপ করত না বিশ্বকাপে। এমন নক্ষত্রপুঞ্জে ১০ নম্বর জার্সি কিনা দেওয়া হলো ১৯ বছরের এক ছেলেকে! এমবাপ্পের প্রতিভা নিয়ে সংশয়ের দিন কেটে গেছে আগেই; কিন্তু বিশ্বমঞ্চে বিশ্বকাপের চাপ নিতে পারবেন কি না—এ নিয়ে আশঙ্কা ছিল খানিকটা।

তা কিভাবেই না দূর করে দেন এমবাপ্পে! তাঁর বিস্ফোরক গতি দিয়ে; তাঁর জাদুকরী ড্রিবলিং নিয়ে। নিজে গোল করে; সতীর্থদের জন্য ভূরি ভূরি গোলের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে। বিশ্বকাপের সব প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন এই টিনএজার। পেরুর বিপক্ষে করেছেন জয়সূচক গোল। আর আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জোড়া গোল করে নিজের সামর্থ্যের চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে দেন এমবাপ্পে। উল্কার মতো মুহূর্তের আলো ছড়িয়ে হারিয়ে যেতে নয়, ধূমকেতুর মতো অনেক দিন টিকে থাকতেই এসেছেন তিনি!

তাইতো আজ বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের আশা-ভরসার প্রতীক তিনি। সে কারণেই তো বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের ‘গোল্ডেন বল’ জয়ে অন্যতম ফেভারিট ভাবা হচ্ছে তাঁকে। ভাবা হচ্ছে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ফুটবল রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে এ বছরের বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের দাবিদার হিসেবেও। ক্যামেরুনের বংশোদ্ভূত বাবা উইলফ্রেড এমবাপ্পে এবং আলজেরিয়ার মা ফাইজা এমবাপ্পের ঘর আলো করে জন্ম তাঁর। বাবা ফুটবল কোচ, মা হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। খেলাধুলা তাই রক্তের ভেতরেই এমবাপ্পের। তাঁর চার বছর বয়সের এক ভিডিও এখনো রয়েছে পরিবারের সংগ্রহশালায়। যেখানে ক্যামেরা হাতে ধরা বাবার সামনে এমবাপ্পে বলছেন, ‘আমি ফুটবলার হতে চাই। ফ্রান্স দলে খেলতে চাই। বিশ্বকাপে খেলতে চাই।’ ছোট ছেলের মুখে এত বড় কথা শুনে বাবা-মা কিছুটা বিরক্তই হতেন বুঝি-বা। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে তা বলেছেন এমবাপ্পে, ‘ছোট থেকেই আমি স্বাপ্নিক। আমার বড় বড় স্বপ্নের কথা শুনে মা-বাবা বলতেন যেন একটু সামলে কথা বলি। এখন তো তাঁরাই বেকায়দায় (হাসি)!’

বাবার ক্লাব এএস বন্ডিতে খেলা শুরু করেন ছয় বছর বয়সে। ওখানকার আরেক কোচ আন্তোনিও রিকার্দির সে দিনগুলো মনে আছে স্পষ্ট, “ছয় বছর বয়সে ওকে প্রথম কোচিং করাই। অন্যদের সঙ্গে পার্থক্যটা বুঝে যাই সঙ্গে সঙ্গে। ওর ড্রিবলিং, ওর গতি—সব কিছুতেই সবার সেরা। প্যারিসে অনেক প্রতিভা হয়তো আছে। কিন্তু আমি ১৫ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে কিলিয়ানের মতো কাউকে দেখিনি। এ জাতীয়দের আমরা বলি ‘ক্র্যাক’; মানে সেরা।” সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমবাপ্পে যোগ দেন ফ্রান্সের বিখ্যাত একাডেমি ক্লেইরেফতে। ক্লাব মোনাকোর যুব দলেও। কিন্তু মূল দলে সুযোগ পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। ওই সময় পিএসজি, লিভারপুল, আর্সেনালের মতো ক্লাব দলে নিতে চায় এমবাপ্পেকে। আর্সেনালের সাবেক কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার তো দেখাই করেন তাঁর ও পরিবারের সঙ্গে। রিয়াল মাদ্রিদ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায় তাদের ক্লাবে। সেখানে প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে ছবিও তোলেন এমবাপ্পে।

পেশাদার চুক্তির প্রস্তাব অবশেষে এমবাপ্পেকে দেয় মোনাকো। ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর লুইস কাম্পোস সবুজ সংকেত পান ভাইস প্রেসিডেন্ট ভাসিলিয়েভ ভামিমের কাছ থেকে। পরে তাঁর স্মৃতিচারণা, “আমার কাছে সেটি মনে হচ্ছিল এটি ঈশ্বরের ইশারা। কারণ এর ঠিক পরপরই চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পাই কিলিয়ানের মাকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলি ৪০ মিনিট। তাঁকে বোঝাই, কিলিয়ানের এমন সময় অন্য বড় ক্লাবে যাওয়া উচিত যখন ড্রেসিংরুমে ঢোকার পর সবাই বলবে, ‘হ্যালো কিলিয়ান, স্বাগতম। আমরা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ আর এখন যদি চলে যায়, তাহলে বড় ক্লাবের ইগোতে ঠাসা ড্রেসিংরুমের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে বলবে, ‘এই পুঁচকেটা আবার কে?’ এই শুনে মোনাকোয় সই করতে রাজি হয় এমবাপ্পের পরিবার।”

২০১৬ সালের মার্চে এমবাপ্পে প্রথম পেশাদার চুক্তি করেন মোনাকোর সঙ্গে। সাইনিং অন বোনাস ৩ মিলিয়ন ইউরো। মাসিক বেতন প্রথম বছর ৮৫ হাজার ইউরো, পরের বছর এক লাখ ইউরো, তৃতীয় বছর এক লাখ ২০ হাজার ইউরো। ১৬ বছর বয়সী কারো তুলনায় অনেক। এই বিনিয়োগ বৃথা যায়নি মোনাকোর। গেল বছর পিএসজির কাছে এমবাপ্পেকে তাঁরা বিক্রি করেছে ১৮০ মিলিয়ন ইউরোতে। বিশ্বকাপে শেষে তাঁকে নিয়ে আরেক দফা কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে—তা নিশ্চিত।

১৬ বছর বয়সে মোনাকোর হয়ে অভিষেক। ১৮ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে দামি টিনএজার। ১৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনালে। কে ঠেকাবে কিলিয়ান এমবাপ্পের এই অবিশ্বাস্য যাত্রা? মোনাকোর সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর কাম্পোস তাই তাঁকে তুলনা করেন রোনালদোর সঙ্গে, একাডেমির ডরমিটরিতে যাঁর পোস্টার ঝুলত এমবাপ্পের ঘরের দেয়ালে, ‘আমি রোনালদোর সঙ্গেও কাজ করেছি। দুজনের মানসিকতার তুলনা করতে পারি। ওরা একই রকম। ওদের জন্ম হয়েছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য; তারকা হওয়ার জন্য; দারুণ সব সাফল্যের জন্য। নিজের সামর্থ্যের ৬০ শতাংশ পর্যায়ে রয়েছে এখন কিলিয়ান। তাতেই বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। একবার কল্পনা করুন তো সামর্থ্যের শতভাগে ও কোথায় পৌঁছাবে। কল্পনা করতে পারছেন? অকল্পনীয় এক ফুটবলার হবে কিলিয়ান।’

গোলের পর বুকের কাছে দুহাত ভাঁজ করে বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে রাখার উদ্যাপন এরই মধ্যে বিশ্বকাপে দেখা গেছে তিনবার। বয়সে সাত বছরের ছোট ভাই ইথানের কাছ থেকে তা পেয়েছেন এমবাপ্পে। প্লে-স্টেশনে বড় ভাইকে প্রতিবার হারানোর পর অমনটা করেন যে ইথান! আজ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ফাইনালেও সে উদ্যাপন দেখার জন্য মুখিয়ে থাকবে ফ্রান্স। ১৯৫৮-র পেলে ও ১৯৮২-র জিওসেপ্পে বার্গোমির পর তৃতীয় টিনএজার হিসেবে খেলবেন বিশ্বকাপ ফাইনাল। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি নিজের প্রথম ফাইনালে করেছিলেন জোড়া গোল। পেলের ছায়া দেখা যাচ্ছে যাঁর ভেতর, সেই এমবাপ্পে কী আজ তেমন কিছু করতে পারবেন!

ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্লেইরেফতে একাডেমিতে খুব জনপ্রিয় ছিলেন এমবাপ্পে। তাঁর খেলার জন্য; তাঁর স্বপ্নের জন্যও। ক্লাব ফুটবলের স্বপ্ন হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে কেউ হাসাহাসি করলে এমবাপ্পের জবাব, ‘চাঁদে যাবার লক্ষ্য স্থির করলে অন্তত মেঘের রাজ্যে তো পৌঁছতে পারব।’

সেই মেঘের রাজ্যে তিনি পৌঁছে গেছেন এরই মধ্যে। আজ চাঁদ স্পর্শের উপলক্ষ। পারবেন না কিলিয়ান এমবাপ্পে!