নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডার লুকা মড্রিচ। মাঝমাঠে থেকে রক্ষণ আর আক্রমণভাগের সাথে অপূর্ব সমন্বয় করতে অদ্বিতীয় তিনি। তাঁর পায়ে বল থাকলেই ছুটে আসে অপোনেন্ট দলের খেলোয়াড়রা। আর তখনই শরীরের দিক পরিবর্তন করে ফাঁকি দেন লুকা। মুহূর্তেই খুঁজে নেন সতীর্থদের।
এখানেই থেমে থাকেন না লুকা। দ্রুতই ফাঁকা জায়গা বের করে অবস্থান নেন, যাতে সতীর্থরাও তাঁকে খুঁজে নিতে পারে। প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে হঠাৎই দূরপাল্লার ক্রসে খুঁজে নেন ফরোয়ার্ডদের।
১৯৮৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন যুগোস্লাবিয়ায় জন্মেছিলেন লুকা। রীতি অনুযায়ী, গ্রাম আর পরিবারের পূর্বসূরীদের নামানুসারে নবজাতকের নাম রাখা হয় ওই এলাকাতে। লুকা মড্রিচের দাদার নাম ছিল লুকা। আর গ্রামের নাম মড্রিচি। দাদা আর গ্রামের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম রাখা হয় লুকা মড্রিচ।
শৈশবেই রক্তারক্তির সাক্ষী লুকা মড্রিচ। যুগোস্লাবিয়া থেকে বের হয়ে স্বাধীনতা চাইছিল ক্রোয়েটরা। কিন্তু এই চাওয়াকে মেনে নিতে পারেনি ক্রোয়েশিয়ায় বসবাসরত সার্বরা।
স্বাধীনতাকে দমন করতে ক্রোয়েটদের ওপর ক্র্যাকডাউন শুরু করে যুগোস্লাবিয়ার সেনাবাহিনী আর সার্ব বিদ্রোহীরা। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র ছিল মড্রিচি গ্রাম।
সার্বিয়ান সেনাবাহিনীতে মেকার হিসেবে কাজ করতেন লুকা মড্রিচের বাবা। তাঁর দাদা সিনিয়র মড্রিচও সার্বিয়ান সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। ১৯৯১ সালে গবাদি পশু চড়াতে গিয়ে সার্ব বিদ্রোহীদের হাতে খুন হন তিনি। গোটা জনপদ পরিণত হয় নরকে।
এই পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে ভিটেমাটি ছাড়ে মড্রিচের পরিবার। উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় ছয় বছরের লুকা। পরিবারে সঙ্গে উদ্বাস্তু হোটেলে থেকে রাস্তায় রাস্তায় ফুটবল খেলে বেড়ায় ছোট্ট মড্রিচ। আর স্বপ্ন দেখে ফুটবলার হওয়ার। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে রক্তাক্ত পরিস্থিতি। ১৯৯১ সালের ২৫ জুন যুগোস্লাবিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ক্রোয়েশিয়া। পরের বছর জোটে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দশ বছর বয়সে ক্রোয়েশিয়ান ক্লাব হাজদুকে যান লুকা মড্রিচ। কিন্তু ছোটখাট গড়ন আর লিকলিকে শরীরের কারণে তাঁকে দলেই নেয়নি হাজদুক। প্রত্যাখ্যাত হয়েও আশা ছাড়েননি তিনি। পনেরো বছর বয়সে আরেক ক্লাব ডায়নামোতে নাম লেখাতে সক্ষম হন মড্রিচ। শুরু হয় ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া।
২০০৪-০৫ মৌসুমে ডায়নামো থেকে ধারে ইন্টার জাপ্রেসিকোতে খেলেন লুকা মড্রিচ। এই ক্লাবের তৎকালীন কোচ স্রিকো বোডানের বর্ণনাতে- নিজে খেলার পাশাপাশি পুরো দলকেই খেলায় লুকা মড্রিচ। রক্ষণের সাথে আক্রমণভাগের সেতুবন্ধন রচয়িতা সে। এজন্যই অনন্য, বিশ্বসেরা লুকা।
ক্রোয়েশিয়ার বিভিন্ন ক্লাব ঘুরে ২০০৮ সালে ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামে যোগ দেন মড্রিচ। তাঁর কাঁধে সওয়ার হয়ে ২০১০-১১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মূল পর্বে স্থান করে নেয় দলটি। এরপরই মড্রিচকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে বড় বড় ক্লাবগুলো। ২০১২ সালে মড্রিচকে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কার জরিপে ২০১২-১৩ মৌসুমে সবচেয়ে বাজে সাইনিং হিসেবে নির্বাচিত হন মড্রিচ। এই অবস্থার মধ্যেও হাল ছাড়লেন না তিনি। ধীরে ধীরে মাদ্রিদের মূল একাদশে জায়গা করে নিলেন মড্রিচ। অসাধাণ নৈপুণ্যের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রাণভোমরা তিনিই। গত পাঁচ বছরে চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা অন্যতম সেরা এই ক্লাবটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ও এই ছোট্ট ক্রোয়েট জাদুকর।
খেলার মাঠে কিংবা ব্যক্তি জীবনে খুবই বিনয়ী, পরিবার অন্তঃপ্রাণ লুকা মড্রিচ নেতা হিসেবেও অসাধারণ।