উদারপন্থী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেলেও হঠাৎ করেই তা কিছুটা থমকে দাঁড়িয়েছে। কারণ দেড় শ আসনের শর্ত দিয়ে পরিস্থিতি একাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী।
মাহীর দল বিকল্পধারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার পক্ষপাতী। অর্থাৎ ক্ষমতায় গেলেও লাগাম যাতে শরিক অন্য দলগুলোর হাতেও কিছুটা থাকে, তার জন্য সংসদে বিএনপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠেকানোর পক্ষে তৎপর বিকল্পধারা। দেড় শ আসনের জন্য দর-কষাকষি সে কারণেই বলে জানা যায়। তবে বিকল্পধারার দেড় শ আসনের এই দাবির বিষয়ে যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলো এখনো পুরোপুরি একাট্টা নয় এবং তাদের সঙ্গে এ প্রশ্নে কোনো আলোচনাও হয়নি বলে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন।
তবে শরিক ওই দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপির মধ্যেও জানাজানি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির প্রবীণ একজন নেতা বলেছেন, ‘মাহী বি চৌধুরীর দাবির কথা শুনেছি। সম্ভবত একাই তিনি ঐক্য প্রক্রিয়া ভণ্ডুল করতে চাইছেন। তবে আমরা হাল ছাড়ছি না।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আসন ভাগাভাগিসহ বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে উদারপন্থী দলগুলোর কার কী পরামর্শ সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করছি। আশা করছি, খুব শিগগির ঐকমত্যে পৌঁছা যাবে।’
তিনি বলেন, রাজনীতির মেরুকরণ ঘটাতে গেলে চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন উঠবে, এটিই স্বাভাবিক। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে ‘ছাড়’ দেওয়ার মানসিকতা সবার থাকবে—সেটিও বিএনপি প্রত্যাশা করে।
জানা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহী বি চৌধুরী গত ৩০ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন। পরদিনই বৃহত্তর ঐক্যের প্রস্তাব নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে বি চৌধুরীর বাসায় যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে বি চৌধুরীর গুরুত্ব ও সম্মানজনক নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন। জবাবে ওই সময় উপস্থিত মাহী বি চৌধুরী স্পষ্ট করে বলেন, ঐক্য গড়তে হলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তফ্রন্টসহ সুধীসমাজ ও অন্য দলগুলোর জন্য বিএনপিকে দেড় শ আসন ছেড়ে দিতে হবে।
তিনজনের ওই বৈঠকের সূত্রে জানা যায়, যুক্তফ্রন্টসহ উদারপন্থী সব দল ও সুধীসমাজ মিলিয়ে ১০০ আসনে সীমাবদ্ধ থাকলে বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে আলোচনা সাপেক্ষে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রয়েছে, যাদের আসন ছাড়তে হবে। তা ছাড়া দেড় শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো অবস্থা উদারপন্থী দলগুলোর আছে কি না তা নিয়েও পরোক্ষভাবে প্রশ্ন তোলেন তিনি। পাশাপাশি আসন বণ্টনের ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাকে একটি দায়িত্বশীল জায়গায় থাকার জন্য অনুরোধ করেন মির্জা ফখরুল। সব শেষে তিনি আরো বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য আনার আরো অনেক উপায় আছে। এ ব্যাপারে বিএনপির প্রস্তাব দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আসন বণ্টন নিয়ে দর-কষাকষি এখনো চলছে এবং বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। পাশাপাশি মাহীকে নমনীয় করে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টাও তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বি চৌধুরী বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা দরকার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আসন বণ্টনসহ সমঝোতার প্রশ্নে নিষ্পত্তি করতে বিকল্পধারার পক্ষ থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মাহী বি চৌধুরী বলেন, বিশ্বাস বা প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে নয়, ক্ষমতার ভারসাম্যের ভিত্তিতে ঐক্য হবে। তাঁর মতে, বৃহত্তর ঐক্য অবধারিত, হবেই এবং বিএনপি এটি মানবেই।
এক প্রশ্নের জবাবে মাহী বলেন, উদার ও বামপন্থী দলগুলোর পাশাপাশি দেশের সুধীসমাজের অনেককেও জাতীয় ঐক্যে শামিল করার প্রক্রিয়া চলছে। প্রয়োজনে ৩০০ আসনে সবাই ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করবে। ‘তাহলে তো বিএনপির আপত্তি থাকার কথা নয়’, যোগ করেন মাহী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতার ভারসাম্য তথা দেড় শ আসনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিএনপির পাশাপাশি যুক্তফ্রন্টের শরিক জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সঙ্গেও আলাপ করছেন মাহী। এ ছাড়া গণফোরাম ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গেও তাঁর আলোচনা চলছে বলে জানা যায়। বিকল্পধারার এই অবস্থান ও দর-কষাকষির পরিস্থিতিতেই গত সোমবার বিএনপির গণ-অনশন কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন বি চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, জেএসডির সভাপতি আ স ম রব এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। তবে দু-একজনের আপত্তি সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্টের শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ওই কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে গেছেন।
মান্না বলেন, ‘স্বৈরতান্ত্রিক সরকার খালেদা জিয়াকে যেভাবে আটকে রেখেছে, সেটি কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা নয় বলে আমরা মনে করি। সরকারের এই ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিবাদ করতে আমি সেখানে গিয়েছি।’ তবে বিকল্পধারার দেড় শ আসন সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টের ভেতরে কোনো আলোচনা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপার কিছু জানি না।’
জানতে চাইলে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘দেড় শ আসনের ব্যাপারে বি চৌধুরীর সঙ্গে আমার কোনো আলাপ হয়নি। আমি কিছু জানি না।’ তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে কোনো কথা হলে তা বিকল্পধারার সভাপতি বি চৌধুরী ও মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের সঙ্গে হয়ে থাকে। মাহীর সঙ্গে আমার কোনো কথা হয় না।’
বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, দেড় শ আসনের বিষয়টিকে লক্ষ্যমাত্রা বলা যায়। কিন্তু এখনই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাহী দেড় শ আসন চাইতে পারে। তার একটি অঙ্ক আছে, আমার অঙ্ক নেই।’ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘বিএনপির কাছে আসন চাইব কেন? তাদের কর্মসূচি সম্পর্কেই জানি না।’
বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যে আলোচনা আছে, বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া কার্যকর হলে বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনকে সরকারের শীর্ষ পদগুলোতে দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হওয়া সম্ভব। তবে ক্ষমতায় গেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অবস্থান কী হবে এ নিয়ে আগ্রহী দলগুলোর মধ্যে নানা কৌতূহল কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে বিকল্পধারার ‘দুশ্চিন্তা’ সবচেয়ে বেশি। কারণ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় চাপ দিয়ে রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। শুধু তাই নয়, বিএনপির হাতে অপদস্থও হয় বি চৌধুরীর পরিবার। আর ওই ঘটনার নেপথ্যে তারেকের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। ফলে ভেতরে ভেতরে ওই ঘটনার নিষ্পত্তি চাইছেন বি চৌধুরী ও তাঁর পরিবার।
অনেকের মতে, এ কারণেই ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে বিকল্পধারার আগ্রহ বেশি। অবশ্য এ বিষয়ে বি চৌধুরীকে নমনীয় করার চেষ্টা অনেক দিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, যিনি বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপি তো বলেছে, ক্ষমতায় গেলে বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো, ড. কামাল হোসেনকে কী করা হবে? সেটি তাঁরা তাঁরা বসে ঠিক করুক।
দেড় শ আসনের ব্যাপারে বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘যেটি বাস্তবসম্মত নয়, সেটি তারা কী করে দাবি করে বুঝলাম না। দেড় শ আসনে তারা প্রার্থী ঠিক করতে পারবে? আসলে তাদের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অথবা এটা পাগলামি হতে পারে। তবু আমি একবার শেষ চেষ্টা করব।’ ‘দেখি, যাব তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে’, যোগ করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
এদিকে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে পৃথক আলোচনা চলছে ড. কামাল হোসেনের। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ দুই নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বৈঠক করেছেন ড. কামালের সঙ্গে। জানা গেছে, কী প্রক্রিয়ায় ঐক্য হতে পারে সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরির ব্যাপারে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে মওদুদ আহমদ জানান, বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে ড. কামালের মনোভাব খুবই ইতিবাচক এবং তিনি কোনো শর্ত দেননি। বলেছেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি কাজ করবেন।
বিকল্পধারা দেড় শ আসন কেন দাবি করেছে, সে বিষয়ে কিছু জানা নেই বলে বলেন, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি দাবি করেন, খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে পরামর্শ করতে বিএনপির দুই নেতা তাঁর কাছে এসেছিলেন। সূত্র: কালের কণ্ঠ