জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র জয়েন্ট কম্প্রিহেনশন স্প্যান অব এ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল তা থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণার পর তার প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সরে যাওয়ার ঘোষণাকে মোটেও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি চুক্তির ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইইউ অংশীদাররা। ইইউ বরাবরই চেয়েছে পরমাণু চুক্তিটিকে যে কোনো মূল্যে জিইয়ে রাখতে। কিন্তু নাছোড়বান্দা ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করতে রাজি নন। এই নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্রদের সঙ্গেও কার্যত দূরত্ব তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। উল্টো ঐ সময়েই তিনি ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠান ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করবে তাদেরও একহাত দেখে নেবেন। ঐ হুমকির অংশ হিসেবে এবার দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের সবচেয়ে বড় মিত্র ভারতকেও রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানি বন্ধ না করলে ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
হুমকির পরও ইরানের থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখে ভারত। বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেয়নি মার্কিন প্রশাসন। সম্প্রতি ট্রাম্প খোলাখুলিই বলেছেন, যে কোনো দেশ ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়বে। ভারতও কী এই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, অবশ্যই ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব পড়বে।
ইরান থেকে তেল আমদানিকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। এরপরই ভারতের অবস্থান। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, ভারত নভেম্বরের মধ্যে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ না করলে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে। ভারতের মাটিতে বসেই বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। দুই দিনের সফরে ভারতে গিয়ে নিকি হ্যালি সরাসরি বলেছেন, ভারতের উচিত ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা। নয়াদিল্লি কোন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কোন মাত্রায় রাখবে তা আরো একবার ভেবে দেখা দরকার ভারতের। ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে বলেও ভারতকে সতর্ক করেন তিনি। নিকি হ্যালি বলেন, তাই ভারতেরও উচিত এই বিষয়টি মাথায় রেখে ইরানের সঙ্গে তেল বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। দীর্ঘদিনের মিত্র ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি শুধু হুমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। আগামী ৬ জুলাই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর আমেরিকা সফরে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেওর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটিও বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে ঐ বৈঠক বাতিলের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এত কিছুর পরও এই হুমকিকে ভারতের পক্ষ থেকে খুব একটা আমলে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ট্রাম্পের ঐ বক্তব্যের পর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, তারা শুধু জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাকেই অনুসরণ করবে। কোনো দেশের একক নিষেধাজ্ঞায় তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে না বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়িয়ে কূটনীতিক সম্পর্ককে অটুট রাখায় বেশি মনোযোগী ভারত। ভারতের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়েছে যে, পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ ও ইরানের কাছ থেকে তেল কেনা নিয়ে মার্কিন-ভারত সম্পর্ক জটিলতায় রয়েছে। শুল্কারোপ নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চললেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এক হাজার বেসামরিক পরিবহন বিমান কিনতে চায় ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তেল ও গ্যাস আমদানিও বাড়াতে চাইছে ভারত। এজন্য নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনকে ইতোমধ্যে প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে নিকি হ্যালির বৈঠকের পরপরই উভয় দেশের সম্পর্কের অবনতির গুঞ্জন ইথারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই গুঞ্জনকে বিরোধীদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার আগেই তা বন্ধ করতে ত্বরিত উদ্যোগ নেয় মোদী সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, দুই দেশের সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে বেছে নেওয়ার ইস্যুতে এখন ভারত যতই কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন নভেম্বরের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। তা না হলে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।