ইইউ থাকবে নাকি ভাঙবে অভিবাসন ইস্যুতে নির্ধারণ

সদ্য সমাপ্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো অবৈধ অভিবাসীদের ইউরোপে আসা কীভাবে সামলাবে সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। তবে ইউরোপে আশ্রয় প্রত্যাশীদের আবেদন প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে নিয়ন্ত্রিত ‘নিরাপদ কেন্দ্র’ গঠন করা যেতে পারে বলে একমত হয়েছে। বলা হচ্ছে, দেশগুলো স্বেচ্ছায় এসব কেন্দ্র স্থাপন করবে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের যাদের আবেদন বাতিল হবে তারা ফের নিজ দেশে ফিরে যাবে। শরণার্থীদের যে দেশ নিতে চাইবে, সেখানে তারা যেতে পারবে। তবে কোন কোন দেশ নিরাপদ কেন্দ্র গঠন করবে কিংবা কারা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গ্রিস এবং ইতালির জনাকীর্ণ ক্যাম্প থেকে এক লাখ ৬০ হাজার শরণার্থীকে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত করার ইইউ’র অভিপ্রায়ও প্রত্যাখাত হয়েছে।

অভিবাসন ইস্যুতে ইউরোপের ঐকমত্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সম্প্রতি ফুটে উঠেছিল জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, শরণার্থী ইস্যুতে সমাধান খুঁজে বের করার সামর্থ্যের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাগ্য নির্ভর করছে। অর্থাত্ শরণার্থী ইস্যুটি কীভাবে ইইউ সামলায় তার ওপরই নির্ভর করছে সংস্থার ভবিষ্যত্।

তিনি বলেন, ইউরোপ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। কিন্তু অভিবাসন ইস্যুর ওপর নির্ভর করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থাকবে না ভেঙে যাবে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে মার্কেল ইউরোপের নিজস্ব মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদী সত্তাকে সামনে টেনে আনেন। কিন্তু ইইউর অপরাপর দেশগুলো এসব মূল্যবোধ থেকেও বেশি গুরুত্ব দিতে চায় তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থাকে।

বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় এই ইইউ ২৮ সম্মেলন। বৃহস্পতিবার দিনের বেলা তর্ক-বিতর্কতো হয়েছেই, রাতেও আলোচনা চলে। পরে শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক টুইট করেন, অভিবাসন ইস্যুতে একটি সমাধানসহ অংশগ্রহণকারীরা একটি যৌথ ঘোষণা দিতে সম্মত হয়েছে।

ব্রেক্সিট নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও শরণার্থী ইস্যুটিই যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। একই সাথে আশংকা করা হচ্ছিল— শরণার্থী ইস্যুতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত আসবে, নাকি হৈহল্লা-হট্টগোল বেঁধে পণ্ড হবে সম্মেলন।

সম্মেলন শেষে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রেখেছেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তাহলে কি শরণার্থী সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে? এক কথায় উত্তর দিতে দিলে বলা যায় -না। কেননা ইউরোপকে অবৈধ অভিবাসী প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যদিকে শরণার্থীদের জীবন রক্ষা করতে হবে। আর এটা যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ শরণার্থীদের নিয়ে আলোচনা চলাকালীন শুক্রবার লিবিয়া উপকূলে নৌকা ডুবে আরো একশ’ জন নিখোঁজের ঘটনা। যাদের মধ্যে ১৪ জনকে উদ্ধার করা গেছে। তিন শিশুর মৃতদেহ সৈকতে ভেসে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপজুড়ে যে প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গঠন করা হবে তার লক্ষ্য হলো— কাজের সন্ধানে আসা অবৈধ অভিবাসীদের ইউরোপে আগমন বন্ধ করা এবং বহির্বিশ্বে এই বার্তা দেওয়া যাতে একমাত্র যাদের আশ্রয় প্রার্থী হওয়ার ও শরণার্থী হওয়ার সকল যোগ্যতা রয়েছে তারাই শুধু ইউরোপে ঢুকতে পারবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রগুলো স্বেচ্ছায় স্থাপন করতে হবে। কিন্তু কখন ও কবে এইসব কেন্দ্র গঠন করা হবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আলোচনা হয়নি। আর এর ফলে শরণার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসতেই থাকবে। আবার নিরাপদ কেন্দ্রের মাধ্যমে ইউরোপ তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবে। এভাবে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।

সম্মেলন যে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যায় শরণার্থী ও আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যাপারে ইউরোপের সব কটি দেশ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে একক কোনো নীতিতে পৌঁছতে পারেনি। জার্মানিতে চলে যাওয়া অভিবাসীদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইতালি । তবে স্পেন ও গ্রিস বলেছে, দেশ দুটিতে নিবন্ধনকৃত শরণার্থী যারা পরবর্তীতে জার্মানি গেছে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। শরণার্থীরা যে কটি দেশে বেশি আশ্রয় নিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ইতালি ও গ্রিস। ইতালির নতুন সরকার ক্রমাগত বলে আসছিল, শরণার্থী বোঝা তারা আর টানতে পারছে না, এবার অন্যরাও কিছুটা বোঝা বহন করুক। নইলে তারা সম্মেলনের সবকটি আলোচ্যসূচিতে ভেটো দিবে। এর ধারাবাহিকতায় ইতালি সম্মেলনে চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে প্রথমে বিরত ছিল।

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো চুক্তিকে অসহায় ও দুস্থ মানুষদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। তারা বলছে, চুক্তির ফলে সাগরে বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্ধার অভিযান সীমিত হয়ে যাবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রেঁদ্ধা সম্পাদিত চুক্তির প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ইউরোপের যে দেশে আগে শরণার্থীরা আসবে সেখানেই কেন্দ্র গঠন করা হবে। তবে তিনি এও বলেন, যেহেতু তার দেশ ইইউভুক্ত প্রথম দেশ নয় যেখানে অভিবাসীরা আগে আসে তাই তার দেশ কোনো ‘নিরাপদ কেন্দ্র’ গঠন করবে না। ইতালি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে। প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টে দাবি করেন ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেকোনো দেশেই কেন্দ্র গঠন করা যেতে পারে। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল সম্মেলনে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, মতভেদ দূর করতে আরো অনেক কিছু করা প্রয়োজন।

সম্মেলনে ইউরোপের দেশগুলোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদারের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়। তুরস্কসহ অন্যান্য উত্তর আফ্রিকার দেশে অর্থ সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এই অর্থ দিয়ে সেখানকার জীবনমান উন্নত করা হবে। যাতে মানুষ অন্যদেশে অভিবাসনে অনাগ্রহী হয়। ইইউ ইউরোপের বাইরেও অভিবাসন কেন্দ্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। যাতে মানবপাচারকারীরা অর্থের বিনিময়ে মানুষদের বিপদসংকুল সাগরে নৌকায় উঠিয়ে দিতে না পারে। প্রসঙ্গত শরণার্থীদের বেশিরভাগই নাইজার, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, সিরিয়া, মরক্কো ও মিসর থেকে আসা।

শরণার্থী নিয়ে ইউরোপে যে বিরোধ চরমে তার নজিরও দেখা গেছে সমপ্রতি। শরণার্থী বোঝাই উদ্ধারকারী একটি জাহাজ কিছুদিন আগে ইতালির বন্দরে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ইতালি লাইফলাইন নামে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তেই দেয়নি। ঘটনাটি ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশের নেতারা দীর্ঘ কূটনৈতিকে তত্পরতা শুরু করেন। সপ্তাহখানেক ধরে চলা আলোচনার ফলে মাল্টায় জাহাজটি ভিড়তে সক্ষম হয়। তবে সিদ্ধান্ত হয়, জাহাজের ২৩৪ জন শরণার্থীকে আটটি দেশ সমান সংখ্যকভাবে গ্রহণ করবে। এর কিছু দিন আগেই ইতালির সাগর থেকে শরণার্থী বোঝাই আরেকটি জাহাজ একুয়ারিসকে বাধ্য করা হয় স্পেনে ভেড়ার জন্য। এমনকি অভিবাসন ইস্যুতে অনেক দেশে সরকারের মধ্যে তীব্র বিরোধ দেখা যাচ্ছে। যেমন জার্মানির চ্যান্সেলর তার জোটের নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোর্স্ট সিহোফারের তীব্র সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। মের্কেলের উদার অভিবাসন নীতির কট্টর সমালোচক এই হোর্স্ট সিহোফারের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়দিন আগে হুমকি দিয়েছেন যে যদি মার্কেল নাও চান তিনি একাই অভিবাসন ইস্যুতে একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন।

শরণার্থীদের ব্যাপারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও রাজনৈতিক দলের মনোভাব এমনই। অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান ঘটতে দেখা যাচ্ছে। যারা দেশের চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে এই ইস্যুটিকেই দুষছেন। সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনের মাধ্যমে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হবে কিনা তা স্পষ্ট হয় ইউরোপীয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্কের মন্তব্যে। তিনি বলেন, সাফল্য নিয়ে কথা বলার এখনো সময় হয়নি। আমরা একটি একটি চুক্তিতে পৌঁছতে সমর্থ্য হয়েছি। চুক্তি বাস্তবায়নে মাঠে কী অপেক্ষা করে তার তুলনায় কোনো একটা চুক্তিতে পৌঁছা অনেক সহজ কাজ।