জার্মানির বিদায়ে একি হল সেই ‘পতাকা আমজাদের’!

মুখের দিকে তাকানোর জো নেই ‘পতাকা আমজাদে’র। লাল-লাল চোখ বলছে, বিশ্বকাপ থেকে জার্মানির বিদায়ে রাতে ঘুম হয়নি তার। আমজাদের ছেলে জানালেন, তার বাবা সকালে অনেক অনুরোধের পর সামান্য নাস্তা করেছেন। রাতে ও দুপুরে খাবার খাননি। কথাও বলছেন না কারও সঙ্গেই। খেলা নিয়ে কথা উঠলেই নীরবে চোখের জল ফেলছেন।

গত বিশ্বকাপে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন মাগুরার ৫৫ বছর বয়সী কৃষক আমজাদ হোসেন। সে বছর তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জার্মান পতাকা প্রদর্শন করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছিলেন তিনি। তখন দেশজুড়ে ‘পতাকা আমজাদ’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই মানুষটি ভেবেছিলেন, ব্রাজিল বিশ্বকাপের মতো এবার রাশিয়া বিশ্বকাপও জিতবে জার্মানি। তাই শত কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে এবার তিনি বানিয়েছিলেন সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জার্মানির পতাকা।

রাশিয়া বিশ্বকাপ-২০১৮ এর গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে ১-০ গোলে জার্মানি হারলেও আমজাদ হোসেনের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েনি। ভেবেছিলেন, বাকি দুই ম্যাচে জয় নিয়ে জার্মানি দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। সুইডেনের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক জয়ও পেয়েছিল চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। জার্মান-ভক্ত হাজারও মানুষের মতো আনন্দে ভেসেছিলেন আমজাদ হোসেনও। তবে পরের ম্যাচে পুঁচকে প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে জার্মানির অভাবিত হারে আমজাদ হোসেনের সব আনন্দ রূপ নিয়েছে গভীর বিষাদে।

বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) দুপুরে সদর উপজেলার ঘোড়ামারা গ্রামে নিজের বাড়িতে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন এ প্রতিবেদক। অন্য সময় সাংবাদিক আসার খবরে পড়িমরি করে ঘর থেকে বের হলেও আজ দেখা করতে চাচ্ছিলেন না তিনি। অনেক অনুরোধের পর ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে আসেন এবং নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে বসেন এ প্রতিবেদকের সামনে।

গলার কাছে, বুকের ভেতরে দলা পাকিয়ে ওঠা কান্নার তোড়ে শুরুতে কোনও কথাই বলতে পারলেন না আমজাদ হোসেন। গভীর বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার চেহারা। কিছুক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে কুশল জিজ্ঞাসার উত্তর দিলেন। তারপর বললেন, ‘অনেক আশা করেছিলাম, জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হবে। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেবে, ভাবিনি।’

থেমে থেমে অনেকটা সময় নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গত বিশ্বকাপে জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা তৈরি করেছিলাম। এবার সেটাকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ করেছি। গতবার চ্যাম্পিয়ন হলেও এবার জার্মানির এরকম পরিণতি হবে, ভাবিনি।’ কথাগুলো বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন আমজাদ।

জার্মান ফুটবলের ভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে নিজে থেকেই বিড় বিড় করে তিনি বলে চলেন, ‘একটা সময় কঠিন অসুখে পড়ে জার্মানির তৈরি ওষুধ খেয়ে সেরে উঠেছিলাম। তার পর থেকে বিশ্বকাপ আসলেই জার্মানিকে সমর্থন করি।’

পতাকা নিয়ে এখন কী করবেন, এ প্রশ্নের জবাবে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘চার বছর পর আমি থাকবো কিনা, কে জানে। যদি থাকি, তখন দেখা যাবে। আমি না থাকলে আমার ছেলেমেয়েরা এসব নিয়ে আগ্রহ নাও দেখাতে পারে। এসব ভেবে ঠিক করেছি, পতাকাটি জার্মান দূতাবাসের হাতে তুলে দেবো।’ কথাগুলো শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালেন আমজাদ হোসেন।

তার ছেলে নাসির বলেন, ‘পতাকাকে ঘিরেই আমাদের বাড়ি এতদিন সরব ছিল। জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দেশের অনেক সাংবাদিকের আনাগোনা ছিল বাড়িতে। বুধবার (২৭ জুন) দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে খেলা চলাকালেও এ বাড়ি ছিল আনন্দে ভরপুর। খেলা শেষ হতেই বাড়িটিতে রাজ্যের নীরবতা নেমে এসেছে।’

কেবল আমজাদের বাড়ি নয়, জার্মানির বিদায়ে তার বাড়ির আশপাশের এলাকায়ও সুনসান নীরবতা নেমে এসেছে। সে কথাই জানালেন প্রতিবেশী লিটন। তিনি জানালেন, ‘আমজাদ চাচাকে নিয়ে আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। এই গ্রামে কত মানুষের পদধূলি পড়েছে শুধু চাচার জন্য। চাচার বাড়িতে আর খেলা দেখতে যাবো না। ওনাকে দেখলে খুব কষ্ট লাগে।’