‘দ্য বস নেইমার’ যাকে কেউ সান্ত্বনা দিয়ে কোনদিন বলেনি যে কত চোরাগোপ্তা আঘাত তোমাকে খেতে হল!‌

তার কাঁধে গোটা দেশের চাপ। তাকে নিয়েই যত প্রত্যাশা। তিনি নিজেও চাইছেন সেই প্রত্যাশার যোগ্য হয়ে উঠতে। সেই লক্ষ্যেই প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলেছেন নিজেকে। প্রত্যাশার চাপ যে কতটা তীব্র হতে পারে, তা তিনি টের পেয়েছেন সুইজারল্যান্ড ম্যাচের পরই। সেই ম্যাচে তিনি গোল পাননি। দলও জেতেনি। বলছি নেইমারের কথা। সেলেকাও ভক্তরা যাকে ‘নেইমার দ্য বস’ নামে সম্বোধন করে।

কিান্তু উল্টো ‘‌স্বার্থপর ফুটবল খেলেছেন’ এই অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল তাকে। অথচ তিনি তো চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। তিন মাস আগে পায়ের অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। তারপর বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়ে একদিন, প্রতিদিন করে নিজেকে তৈরি করেছেন। বিশ্বকাপের আগে দুটো প্রস্তুতি ম্যাচে গোল করেছেন দেখার মতো। যা দেখে গোটা ব্রাজিল হয়েছে উদ্দীপ্ত। কিন্তু সুইজারল্যান্ড ম্যাচে কী যে হল!‌ দৌড়াচ্ছেন, কিন্তু সেই দৌড়ে কোন দিশা নেই। বলের কাছে পৌঁছাচ্ছেন, কিন্তু খেলছেন পা বাঁচিয়ে। কারণ, সে ম্যাচে প্রতিপক্ষের প্লেয়াররা যে নেইমারের দু’টো পাকেই বল মনে করে শট নিচ্ছিল। একবার বা দু’বার নয়, পরপর দশবার। ফলে সবকিছু মিলিয়ে চাপে পড়াই তো স্বাভাবিক। কই, কেউ তো সান্ত্বনার হাত পিঠে রেখে বলেনি যে, কত চোরাগোপ্তা আঘাত তোমাকে খেতে হল!‌

বিশ্বকাপের মঞ্চে কে আর সমালোচিত হতে চান!‌ এত সমালোচনা যদি একসঙ্গে ধেয়ে আসে, কারও মাথা কি ঠিক থাকে?‌ কোস্টারিকা ম্যাচের আগে সংকল্প নিলেন, আর কাউকে তার দিকে আঙুল তোলার সুযোগ দেবেন না। ওই ম্যাচে শুরু থেকেই নেইমারকে দেখা গেছে ছটফট করতে। নিজেকে প্রমাণের মরিয়া তাগিদ। এটাও ঠিক যে, ফিটনেসের চূড়ান্ত পর্যায়ে নেই নেইমার। ফলে পুরোপুরি পারছেন না নিজেকে মেলে ধরতে। যদিও বিশ্বের এই মুহূর্তের সবথেকে দামি ফুটবলার সেই ঘাটতি পুষিয়ে দিতে চাইছেন অসম্ভব মনের জোর দিয়ে।

কোস্টারিকা ম্যাচে এমন কয়েকটা সুযোগ নেইমার মিস করেছেন, যা চূড়ান্ত ফর্মে থাকলে নিশ্চিতভাবেই বল জালে জড়িয়ে দিতে পারতেন। অবশেষে গোল পেয়েছেন শেষমুহূর্তে। বুকের ওপর থেকে চাপের পাহাড়টা যেন ওইমুহূর্তেই সরে গিয়েছিল। ম্যাচ শেষে শিশুর মতো কেঁদেছেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। শারীরিক, মানসিক সব যন্ত্রণা সেদিন চোখের জলের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল।

‘এই জায়গায় পৌঁছতে ‌কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমি এসেছি, সবাই তা জানে না। এই কান্না আনন্দের, বাধা অতিক্রম করার। কারণ আমার প্রতিজ্ঞা, আমার ইচ্ছের জয় হয়েছে আজ। আমার জীবনে কোনও কিছুই সহজভাবে হয়নি’‌, ম্যাচের পর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন নেইমার।

তবুও কেউ কেউ থামার পাত্র নন। আসলে সমালোচকরা এত সহজে ছাড়েনও না। তাদের বক্তব্য, বিশ্বকাপে যখন গোটা দল তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, গোটা দেশ তোমাকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধে, তখন চাপ তো নিতেই হবে। ফলে গোল পেয়ে এত কান্নার কী আছে!‌ আসলে নেইমার মোটেই মানসিকভাবে দৃঢ় নন!‌ সত্যি, বিচিত্র অভিজ্ঞতা!‌ গোল করলেও দোষ, না করলেও দোষ!‌

যদিও গোটা সেলেকাও রয়েছে নেইমারের পাশে। তিন ম্যাচে সাত পয়েন্ট নিয়ে নকআউট নিশ্চিত। সতর্কতার চাদরে নিজেদের মুড়ে রেখেছে তিতের দল। তার মধ্যেও অনুশীলনে হাসি, ঠাট্টা, খুনসুটি— সবই চলছে। মধ্যমণি সেই নেইমার।

আগের ম্যাচের গোল চাপ কাটিয়ে এনে দিয়েছে টাটকা বাতাস। তিনিও হাসছেন, সতীর্থদের পেছনে লাগছেন। সেলেকাওয়ের অঘোষিত নেতা যে তিনিই!‌ নেইমারকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে যাবতীয় স্বপ্ন। তিনিও নিজেকে বাঁধছেন প্রতিজ্ঞার বাঁধনে। জয় আনতে হবে। গোলের রাস্তা খুলতে হবে। ছুঁড়ে ফেলতে হবে যাবতীয় সমালোচনাকে। ষষ্ঠবার দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিতেই হবে। এ স্বপ্ন যে হেক্সা পূরণের স্বপ্ন। সেদিন যদি আবার চোখে জল আসে?‌ আসুক।‌