রবিবার তুরস্কে প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়েছেন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। এছাড়া একইদিনে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচনে এরদোগানের দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এই নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করবে তুরস্ক।
প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি প্রবর্তনের পর প্রথম অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে এরদোয়ান পেয়েছেন ৫৩ শতাংশ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুহাররম ইনচে পেয়েছেন ৩১ শতাংশ ভোট। অন্য চার প্রার্থীর সবার প্রাপ্ত ভোট ৮ শতাংশের নিচে। নির্বাচনে কোনও প্রার্থী এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে মুহাররম ইনচের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হতো এরদোয়ানকে। তবে ৫৩ শতাংশ ভোট পাওয়ায় সরাসরি আবারও তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন তিনি।
এছাড়া পার্লামেন্ট নির্বাচনেও এরদোয়ানের একে পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ৯৭.৭ শতাংশ ভোট গণণা শেষে একে পার্টি জোটকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কাউন্সিল। বাকি ভোট না গুণলেও ফলাফলে কোনও প্রভাব পড়বে না বলে জানানো হয়েছে। খবর তুর্কি গণমাধ্যম আনাদুলু এজেন্সির।
জোটগতভাবে বিজয়ী হওয়ার করণে পার্লামেন্টে একে পার্টির একক আধিপাত্যের অবসান হয়েছে। এখন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে তাদের জোট সঙ্গী এমএইচপির সমর্থন প্রয়োজন হবে। আর কোনও সাংবিধানিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রধান বিরোধী জোট সিএইচপি অথবা কুর্দি সমর্থিত দল এইচডিপির সমর্থন প্রয়োজন হবে।
নির্বাচনে জয়লাভের পর এ ফলাফলকে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এরদোয়ান। বিজয়কে ‘ঐতিহাসিক দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এমএইচ পার্টির নেতা ডেভলেট বাচেলি। আর ভোটের ফলাফল মেনে নিতে বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এরদোয়ানের একে পার্টি।
এরদোয়ানের বিজয়ের পর দেশব্যাপী বিজয় মিছিল করেছে এরদোয়ান সমর্থকরা। রাতে তারা আলো জ্বালিয়ে জয় উদযাপন করেছে একে পার্টির নেতৃত্বে পিপলস অ্যালায়েন্স জোট সমর্থকরা।
সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্কের অন্তর্তভুক্তিসহ মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন এরদোয়ান। দেশটিতে এতদিন পার্লামেন্ট সদস্যদের দ্বারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। আর প্রেসিডেন্টের পদ ছিলো বাংলাদেশের মত আলংকারিক। তবে গত বছরের ১৬ এপ্রিল গণভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অনুমোদন পায়। এই পরিবর্তনের ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হবেন প্রেসিডেন্ট।
নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০১৯ সালের নভেম্বরে হওয়ার কথা থাকলেও এরদোয়ান নির্ধারিত সময়ের বছরখানেক আগেই নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।
তুরস্কে এরদোয়ান বিপুল জনপ্রিয় হলেও এবারের নির্বাচনে বেশ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। তবে শেষপর্যন্ত জয় এসেছে তারই।
নির্বাচনে জিতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন এরদোয়ান। এখন তুরস্ক সংশ্লিষ্ট সিরিয়াসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আরও ভালোভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবেন এরদোয়ান। জোটকে সঙ্গে নিয়ে কতটা প্রভাব বিস্তার করবেন এরদোয়ান সরকার তা সময়ই বলে দেবে।
গত দেড় দশকে ১৪টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিটিতে জয়ী হয়েছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলের কাশিমপাশায় জন্ম এরদোয়ানের। বাবা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের ক্যাপ্টেন। মারমারা ইউনিভার্সিটিতে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। যোগ দেন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিস স্টুডেন্ট ইউনিয়নে। ফুটবলও খেলতেন স্থানীয় একটি নামকরা ক্লাবে।
ছাত্রজীবন শেষে যোগ দেন নাজিমউদ্দিন আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির যুব সংগঠনে। ১৯৮০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দলটি বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন। এই দল থেকেই ১৯৯৪ সালে নির্বাচিত হন ইস্তাম্বুলের মেয়র।
১৯৯৮ সালে সেক্যুলার সরকার ওয়েলফেয়ার পার্টি নিষিদ্ধ করে। কয়েক মাস জেল খাটতে হয় তাকে, সেই সাথে পড়তে হয় রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে যা একে পার্টি নামে পরিচিত। ২০০২ সালে প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েই জয়লাভ করে দলটি।
পুনর্বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যেসব ক্ষমতার অধিকারী হলেন এরদোয়ান-
১. মন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্টসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা,
২. দেশের আইনি ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা,
৩. জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করতে পারবেন তিনি।
তুরস্কের অবস্থান এমন এক জায়গায় যে এর নেতা কে হচ্ছেন তার বৈশ্বিক গুরুত্ব আছে। কারণ তার একদিকে ইউরোপ, অন্য দিকে ইরাক আর সিরিয়ার সীমান্ত। এর মধ্যে বৃহৎ মুসলিম বিশ্বের এক নেতৃস্থানীয় দেশ তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্বেরও এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, নেটো জোটের সদস্য। তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও সদস্য পদপ্রার্থী। তুরস্কের সেনাবাহিনী নেটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাহিনী।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, কুর্দি সমস্যা, ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই, অভিবাসী সংকট- ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তুরস্কের ভুমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।