প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন। তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় সরকার প্রধান যিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সন্তানের মা হলেন।
এ ঘটনার সাথে-সাথে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় আসছেন পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নাম, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এখানে কিছু কাকতালীয় বিষয় রয়েছে। আবার পার্থক্যও আছে অনেক। যেমন একটি উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মা হওয়ার সময় সব রকম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু পাকিস্তানের মত অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে কোনো রকম সুবিধাই পাননি বেনজির। বরং তাকে মা হওয়ার কথাটি পর্যন্ত গোপন রাখতে হয়েছিল। কোনোরকম মেটার্নিটি লিভ নেয়া তো দূরের কথা।
সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানের সাথে একটি ছবি ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
তবে এই দুই নারীর মিলও কিন্তু কম নেই। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ জুন)। এটি ছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোরও জন্মদিন। ৬৫ বছর আগে এ দিনটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেনজির ভুট্টো।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ৩৭ বছর বয়সে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বেনজির ভুট্টোও মা হয়েছেন ওই একই বয়সে অর্থাৎ ৩৭ বছর বয়সে। বেনজিরের প্রথম সন্তানও মেয়ে। তিনি ১৯৯০ সালে তার বড় মেয়ে বখতাওয়ার ভুট্টো জারদারিকে জন্ম দিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার এক টুইট বার্তায় বখতাওয়ার ভুট্টো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বেনজির কন্যা বখতাওয়ার ভুট্টো জারদারি তার টুইট বার্তায় লিখেছেন, বেনজির ভুট্টো দেখিয়েছিলেন যে আপনি একই সাথে মা হতে পারেন এবং প্রধানমন্ত্রীও থাকতে পারেন।
বেনজির ভুট্টো যখন তর কন্যা বখতাওয়ার ভুট্টোর জন্ম দিয়েছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এক বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন ক্ষমতায় আসার এক বছর এখনো পূর্ণ হয়নি।
আরডার্নের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার ছয় মাস আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি সন্তানসম্ভবা। তিনি এরই মধ্যে ছয় সপ্তাহের মাতৃত্ব-কালীন ছুটি নিয়েছেন এবং তার সহকারীর কাছে সাময়িক সময়ের জন্য দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন।
কিন্তু বেনজির ভুট্টো তার গর্ভবতী হবার বিষয়টিকে গোপন রেখেছিলেন এবং ডাক্তারের পরামর্শে দ্রুত কাজে ফিরে আসেন। বেনজির ভুট্টোর সন্তানসম্ভবা হবার বিষয়টি শুধু যে দেশবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা নয়, এমনকি তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরাও এ বিষয়ে কিছু জানতেন না।
২০০৭ সালে এক নির্বাচনী জনসভার পর রাওয়ালপিন্ডিতে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়
বেনজির ভুট্টোর মন্ত্রী পরিষদের এক সদস্য জাবেদ জব্বার পরবর্তীতে বিবিসিকে বলেছিলেন, আমাদের মন্ত্রী পরিষদের কোন সদস্যই জানতেন না যে প্রধানমন্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। আকস্মিকভাবে আমরা জানতে পরলাম যে তিনি শুধু গণতন্ত্রের জন্ম দেননি, একই সাথে তিনি সন্তানেরও জন্ম দিয়েছেন।
বেনজির ভুট্টো সে সময় উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরে ছিলেন। যখন বখতাওয়ারের জন্ম হয় সে সময় সেনা-সমর্থিত একটি ডানপন্থী রাজনৈতিক জোট সরকারকে ঘিরে ধরেছিল। তিনি তখন একটি অনাস্থা ভোটে টিকে গিয়েছিলেন।
এ অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে বেনজির ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সে সময় পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বা আইএসআই তার দল থেকে অর্থের বিনিময়ে সংসদ সদস্যদের ভাগিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল।
পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রেসিডেন্টের যে একক কর্তৃত্ব ছিল সেটিকে বাতিল করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন বেনজির ভুট্টো। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হননি। সেজন্য বেনজির যখন সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন তখন তিনি বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি এবং মাতৃত্বকালীন কোন ছুটিও নেননি।
বেনজিরের ব্যক্তিগত গাইনোকলজিস্ট তার অপারেশন করেছিল এবং সন্তান জন্মের পর ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তিনি দ্রুত কাজে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, পরের দিন আমি কাজে ফিরেছিলাম। সরকারি কাগজপত্র পড়েছি এবং সরকারি ফাইলে স্বাক্ষর দিয়েছি। পরে আমি জানতে পারলাম যে ইতিহাসে আমিই হচ্ছি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সন্তানের জন্ম দিয়েছে।
বেনজির ভুট্টো বলেছিলেন যে তার সন্তান জন্মদানের বিষয়টি তখন নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কারণ এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে একজন নারী নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকে এবং নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সে সন্তানের জন্ম যেমন দিতে পারে তেমনি কাজও করতে পারে।
তিন সন্তানের সঙ্গে বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের রাজনীতিতে যত অনিশ্চয়তা এবং বিপদ আছে সেটি নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে নেই। বখতাওয়ারকে জন্মদানের কয়েকমাস পরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান বেনজির ভুট্টোর সরকারকে বরখাস্ত করেছিল। এরপর একটি কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে বেনজির ভুট্টোর প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। তৎকালীন বিরোধী নেতা সৈয়দা আবিদা হুসাইন বেনজিরকে ‘লোভী’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
তিনি অভিযোগ করেন, বেনজির ভুট্টো দেশের সেবা না করে বরং ‘মাতৃত্ব, পরিবার এবং গ্ল্যামারের’ দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন।
তার অপর দুই সন্তান অর্থাৎ ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো এবং মেয়ে আসিফা ভুট্টোর জন্মও একইভাবে গোপনীয়তার ভেতর দিয়ে হয়েছিল।
১৯৮৮ সালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং সে বছর নভেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। বেনজির ভুট্টো তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন এবং তার গর্ভে তখন ছিল বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।
একটা কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে যে গোয়েন্দা রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে জেনারেল জিয়া নভেম্বর মাসের শেষ দিকে নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। কারণ গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে নভেম্বর মাসে বেনজিরের সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে আসবে এবং সেজন্য তিনি ভালোমতো নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না।
কিন্তু বিলাওয়ালের জন্মের খবর আসে সেপ্টেম্বর মাসে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় তখন সেটি গতির সঞ্চার করে। বলা হয়ে থাকে, বেনজির ভুট্টো ইচ্ছাকৃতভাবে সন্তানের জন্মদানের সময় সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করেছিলেন।