ইকুয়েডরের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ওই ম্যাচটাকে কি এখন দূর অতীতের স্মৃতি বলে ভ্রম হচ্ছে লিওনেল মেসির?
বাঁচা-মরার সেই শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছিলেন, তার আগে তো বিশ্বকাপে খেলা নিয়েই শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। ইকুয়েডরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের পর সারা দেশে মেসি-বন্দনা। আর্জেন্টিনার মানুষের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিল একান্ত আপনজন।
কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের পর সেই আগের অবস্থা। আইসল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ ড্র করার পর আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়, কোচ—সবার দিকেই সমালোচনার তির ছুটছে। তবে সেই তিরে সবচেয়ে বিদ্ধ হচ্ছেন মেসিই। হওয়ারই কথা! পেনাল্টি মিস করেছেন, ছড়াতে পারেননি আলোও। ‘ছেলেটা ঠিক আর্জেন্টিনার নয়’—এমন সমালোচনাও তাই আবার ফিরে আসছে।
মেসির কেমন লাগছে, কে জানে! তবে এসব সমালোচনা শুধু যে আর্জেন্টাইন অধিনায়ককেই আক্রান্ত করে তা নয়, আক্রান্ত করে তাঁর পরিবারকেও। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের পর আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেল এল ত্রেসের একটা অনুষ্ঠানে মেসির মা সেলিয়া মেসির কণ্ঠে ফুটে উঠল সেই ভোগান্তির কথা। পাশাপাশি তাঁর প্রত্যাশা, ছেলের প্রতি মায়ের উপদেশ, তাঁর অনুযোগ…থাকল সবই।
‘এল দিয়ারিও দো মারিয়ানা’ নামের সেই অনুষ্ঠানে গত পরশু শুধু মেসির মা নন; এসেছিলেন সার্জিও আগুয়েরো, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, হাভিয়ের মাচেরানো, লুকাস বিগলিয়াসহ অনেকের মায়েরাও। তবে সবচেয়ে বেশি জোরালো হয়ে বাজছে সেলিয়া মেসির কথাগুলোই, ‘লিওকে যে সমালোচনা সইতে হয়, তা আমাদেরও আঘাত করে। সবাই যে বলে, ‘‘ও জাতীয় দলের জার্সিটা ঠিক হৃদয় দিয়ে অনুভব করে না’’, বা ‘‘শুধু দায়িত্বের কারণেই ও জাতীয় দলে খেলছে’’…এসব একেবারেই সত্যি নয়। আমরা যা দেখি, সেটা যদি ওরাও দেখত! ওর (মেসি) ভোগান্তি, কান্না…এসব খুব ব্যথা দেয়।’
সে ব্যথায় মেসিদের ভুগতে হচ্ছে গত বিশ্বকাপের পর থেকেই। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর টানা দুই বছরে দুটি কোপা আমেরিকা, সর্বশেষ তিনটি বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই ফাইনালে খেলেছে মেসির আর্জেন্টিনা। কিন্তু শিরোপার ঘরটা শূন্যই। আর্জেন্টিনার মতো সাফল্যবুভুক্ষু দেশে রানার্সআপের ট্রফির তো মূল্যই নেই। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পরশু অনুষ্ঠানে বিগলিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, ‘ওদের যা করতে হবে তা হলো, চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। আশা করি, এই বছরটা ওদের হবে।’
সেই আশা কি আর মেসিদের নেই? আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের জন্য এখন বিশ্বকাপ জেতা এখন অনেকটাই জীবন-মরণের প্রশ্ন। ব্যাপারটা যেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের পর ৩২ বছর ধরে বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে ওঠা চাপটা সরানোর মিশনও! আর মেসির জন্য আরেকটু বেশি কিছু। নিজের ক্যারিয়ারে পূর্ণতা আনা। আর্জেন্টিনার জার্সিতে কিছু করে দেখানো। মেসির মা সেটিই বলছিলেন, ‘সবার প্রথমে যদি কেউ বিশ্বকাপটা জিততে চায়, তবে সেটি ও-ই। ও কাপটা দেশে আনতে চায়। বিশ্বকাপটাকে নিজের করতে ও যেকোনো কিছুই করতে প্রস্তুত। এই ইচ্ছাটাই এখন ওর সবচেয়ে বড় ইচ্ছা।’
ইচ্ছাপূরণে কী করতে হবে, ছেলেকে সেই উপদেশও দিয়ে রেখেছেন সেলিয়া মেসি, ‘ওকে দেখে অনেক শান্ত, নির্ভার মনে হয়েছে। আমি ওকে বলেছি ঠিকঠাকভাবে নিজের যত্ন নিতে। আর ও যেটা জানে সেটাই করতে। খেলাটা উপভোগ করতে। আর চাই একেবারে ছোট্টটি থাকার সময় গ্রন্দোলিতে (মেসির শৈশবে বাড়ির পাশের অপেশাদার ক্লাব) যেভাবে খেলত, সেভাবেই যেন খেলে।’
তাতে আরেকবার ইকুয়েডর ম্যাচের স্মৃতিটা ফেরাতে পারবেন মেসি? আজ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটাও যে আর্জেন্টিনার বাঁচা-মরারই। বিশ্বকাপে টিকে থাকার ম্যাচ।
মেসি তা করতে পারলে হয়তো চোখের কোণ চিকচিক করে উঠবে সেলিয়া মেসিরও। তবে এবার সেটার কারণে ভোগান্তি হবে না।