সৌদি-পাকিস্তান কৌশলগত সম্পর্ক কোন পথে?

সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল একবার সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ককে ‘আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি ছাড়াই দুই দেশের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রিন্স তুর্কি ছিলেন সৌদি সিদ্ধান্ত প্রণয়নের সাথে জড়িত। তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তান অভিযান ও ৯/১১-পরবর্তী প্রতিরক্ষা কূটনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন।

সম্পর্কে কিছু জটিলতাও আছে। ইয়েমেনে চলমান যুদ্ধে সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোটে ইসলামাবাদের সামরিক সম্পৃক্ততা নিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টের বিরোধিতা বিতর্ক উস্কে দিয়েছে, দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্কের সারমর্ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। অবশ্য ওই যুদ্ধে পাকিস্তান সম্পৃক্ত হয়নি। সৌদি জোটে পাকিস্তান মূলত আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেই ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়লে হুতিদের শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষক ইরানের সঙ্গে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা আরো বাড়ার শঙ্কা থেকে যায়।

ইয়েমেন সঙ্কটে পাকিস্তানের নিরপেক্ষতা সত্ত্বেও সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক জোরালোই রয়ে গেছে। আরো ২০টি আরব ও মুসলিম দেশের সাথে সৌদি আরবে ‘নর্থ থান্ডার’ নামে মহড়ায় অংশগ্রহণ, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল রাহেল শরিফের ‘ইসলামিক অ্যালায়েন্স অব ফাইট টেরোরিজমের’ কমান্ডার-ইন-চিফ হওয়ার মধ্যেই তা প্রতিফলিত হয়। এখনো পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক দুই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের চেয়ে সৌদি বাদশাহ আর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করে।

সামরিক সহযোগিতার বিনিময়ে বিভিন্ন খাতে সৌদি বিনিয়োগ ঘটে থাকে। ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি পর্যায় পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য বিনিময় ঘটেছে ৫ বিলিয়ন ডলারের। আর ২০০২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বাণিজ্য হয়েছে ৩০.৭ বিলিয়ন ডলারের। আর পাকিস্তানকে সৌদি আরবের সহায়তা কেবল আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বিভিন্নভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করে থাকে সৌদি আরব।

রিয়াদ ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সামরিক সম্পর্কের সূচনা ষাটের দশকে। ওই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৌদি সশস্ত্র বাহিনী গঠনে সহায়তা করে। সৌদি রাজকীয় বিমানবাহিনীকে প্রথম জঙ্গিবিমান দিয়েছিল পাকিস্তানই। সৌদি আরবের বিভিন্ন নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে এক হাজার ২০০’র বেশি পাকিস্তানি প্রশিক্ষক কাজ করছেন।

বর্তমানে সৌদি আরবে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, তাতে দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক আরো জোরদার হতে পারে। আর তা কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরই নির্ভরশীল থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সৌদি প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করেছে।

এছাড়া সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান ফেব্রুয়ারিতে রিয়াদে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে স্বাগত জানান। তারা দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ মহড়া, সামরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর তারা জোর দেন। সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব।

আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সৌদি আরব ও পাকিস্তান পারস্পরিক নির্ভরশীল নিরাপত্তা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। আবার পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে কোনো ধরনের ক্ষতি না করেই ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী সৌদি আরব। ইয়েমেনে জড়িত না হলেও সৌদি আরবকে পাকিস্তান আশ্বাস দিয়েছে, যখনই প্রয়োজন পড়বে, দেশটির নিরাপত্তাগত সহায়তায় এগিয়ে আসবে পাকিস্তান। বিনিময়ে কাশ্মীর সমস্যায় পাকিস্তানকে সমর্থন প্রদান করার কথা ঘোষণা করেছে সৌদি আরব।

অধিকন্তু সৌদি আরব সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) যোগ দেবে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এদিকে সৌদি আরবের শীর্ষ ইংরেজি ওয়েবসাইট ‘আরব নিউজ’ বিশেষ পাকিস্তান ব্যুরো ও ওয়েবসাইট খুলেছে। সৌদি আরবের বাইরে এটিই তাদের এ ধরনের প্রথম প্রয়াস।

সংক্ষেপে বলা যায়, সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক কৌশলগত দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে উভয় দেশের কৌশলগত স্বার্থ পূরণ করতে যাচ্ছে।