বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর জোরালোভাবে আলোচনায় এসেছে নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতার বৈষম্য। আগেও এ বিষয়ে আলোচনা হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এশিয়া কাপ জয়ের পর নারী ক্রিকেট দলকে দুই কোটি টাকা পুরষ্কার ও প্রত্যেক ক্রিকেটারকে ১০ লাখ টাকা করে আর্থিক পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ আছেন ১৭ জন নারী ক্রিকেটার। তাদের বেতন সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। ছেলেদের ক্রিকেটে সর্বনিম্ন বেতন লাখের কাছাকাছি।
ছেলেদের জাতীয় লিগে প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ২৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় স্তরে ২০ হাজার। বিসিএলে ম্যাচ ফি ৫০ হাজার টাকা।
মেয়েদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ ফি ৬০০ টাকা মাত্র। যদিও পরবর্তীতে ম্যাচ ফি ৪’শ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল।
এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারের পর সবগুলো ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ফাইনালে ভারতকে হারানোর আগে গ্রুপ পর্বেও ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ফাইনাল ম্যাচে শেষভাগে জয়ের ক্ষেত্রে স্নায়ুচাপ সামলে বড় ভূমিকা রেখেছেন জাহানারা আলম। তার কাছে এই জয় বিশেষ কিছু।
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের সাবেক এই অধিনায়ক মনে করেন, নারী ক্রিকেট দল তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে জয় পেয়েছে। এখানে কোনো ছাড় দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ২০১০ এশিয়াডে গুয়াংজুতে যখন আমরা সিলভার মেডেল পেলাম তখন থেকেই এই প্রত্যয় তৈরি হয় যে আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারবো।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পুরষ্কার ঘোষণায় কতটা সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন জাহানারা আলম?
“দেখুন, এখানে খুশি বা অখুশি হওয়ার কিছু নেই, আমরা আমাদের কাজটা পূরণ করেছি। এটা আমাদের দায়িত্ব ছিল। যেটা আমরা বহুদিন করে আসতে পারিনি। আমাদের ভালো ফলাফল দিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের খুশি করতে পেরেছি এটাই বড় ব্যাপার, এখন বোর্ড যাই করবে সেটা বোনাস।”
বেতনের ব্যাপারটাও বোর্ডের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তার মতে, এটা ভাবার জন্য বোর্ডের কর্মকর্তারা আছেন। এটা নিয়ে মাথা ঘামালে ক্রিকেট খেলায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
সালমা খাতুন দুই বছর পর অধিনায়কত্ব পেয়েই বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা পেয়েছেন। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের পরিচিত এই মুখ বলেন, “আগে কিংবা পরে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে যে সাহায্য ছিল না তেমন নয়, হয়তো একটু কম ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় সংবর্ধনায় ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট বলেছেন সবসময় তাদের সাথে থাকবেন।”
এই জয়টাকে একটা মঞ্চ মনে করেন সালমা খাতুন। তার মতে, আকরাম খান বা খালেদ মাহমুদ সুজনরা যখন খেলেছেন তখন বর্তমান পুরুষ দলের মতো সুবিধা পাননি। এখন যে নারী দল খেলছে তারা সেই মঞ্চ তৈরি করে দিবেন, যাতে ভবিষ্যৎ নারী ক্রিকেটাররা আরো ভাল সুযোগ সুবিধা পান।
ফাইনালে ভারত ও গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভাল ব্যাট করেন নিগার সুলতানা জ্যোতি। বাংলাদেশের শেরপুর জেলা থেকে উঠে আসা এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান বলেন, মেয়েদের ক্রিকেট ছেলেদের থেকে একটু অবহেলিত। মিডিয়ার ফোকাসটা নেই। অনেক খেলা সরাসরি দেখানো হয়না, তার মধ্যেও এই জয়টা অনেক বড় বার্তা দেবে।
খুব রাতারাতি পরিবর্তনের আশা করছেন না জ্যোতি। তার বিশ্বাস, এই জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলেই গুরুত্ব অর্জন করা সম্ভব হবে।
বিসিবি কী বলছে?
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মতে, নারী ক্রিকেটারদের এশিয়া কাপ জয় শুধু ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেই এটা সবচেয়ে বড় অর্জন।
তার মতে, এই সাফল্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লম্বা পরিবর্তনের ফসল।
তিনি বলেন, “নারীদের ক্রিকেট নিয়ে একটু হতাশ ছিলাম, কিন্তু তাই বলে এমন না যে বোর্ড কিছু করেনি। তিন বছর ধরে প্রস্তুতি চলছে, আমরা মেয়েদের বেলাতেও বিদেশী কোচ এনে দিয়েছি। ভারতের মেয়েদের দলের হেড কোচকে আমাদের হেড কোচ করেছি। ফিজিও এনে দিয়েছি। তাই বোর্ড কিছু করেনি, এমনটা মনে হলে সেটা ভুল।”
তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারত প্রচুর বিনিয়োগ করেছে যার ফলাফল তারা বিশ্বকাপের রানার্স আপ ও এশিয়া কাপে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন। তাদের হারানোটা অনেক বড় ব্যাপার।
মেয়েদের আর্থিক অবস্থার সাথে ছেলেদের আর্থিক অবস্থা তুলনা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন বিসিবি প্রধান।
তিনি বলেন, “অনেক মেয়েই নতুন খেলা শুরু করেছে, তাদের সাথে ছেলেদের মূল দলের তুলনা দেয়া অনেক কঠিন। যেমন তুষার ইমরান এত বছর ধরে খেলছে তার বেতন গত সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল ২২ হাজার টাকা। তবে তামিম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ ওদের সাথে তুলনা করাটা চলে না।”
তবে মেয়েদের সাফল্যের ফলে আরো বেশি মেয়ে ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী হবে বলে মনে করেন তিনি। এক বা দুই দিনের মধ্যে মেয়েদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর ব্যাপারে ঘোষণা আসবে বলে জানান।
আরো পড়ুন : সালমাদের জয়ে তামিমদের উল্লাস এখন ভাইরাল
জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১ বলে ২ রান। এমন শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে চাপ সামলে রেখে কাজটুকু করা খুব কঠিন। সেটা একমাত্র তিনিই বুঝতে পারেন, যিনি সেই সময় ক্রিজে দাড়িয়ে আছেন। এশিয়া কাপের ফাইনালে সেই মুহূর্তটিতে ক্রিজে ছিলেন জাহানারা আলম। বাংলাদেশকে ইতিহাসের পাতায় তুলতে তিনি দুর্লভ সেই মুহূর্তের নায়ক বনে যান। সপাটে চালান ব্যাট, তুলে নেন ২ রান, জয়ের আনন্দে ভাসান পুরো বাংলাদেশকে। চ্যাম্পিয়ন হন এশিয়া কাপে। যে কাজটি অসাধ্য মনে হয়েছিল মাশরাফি-তামিমদের বেলায়। এশিয়া কাপের শিরোপার দোরগোড়ায় গিয়েও শিরোপা ছুঁতে পারেনি তারা। সেই দুঃখ হয়ত এখন কিছুটা হলেও খুচেছে তাদের। কাল সালমাদের জয়ে উল্লাস করেছে তারা, যা এখন ভাইরাল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের প্রস্তুতিতে ছিল বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারেরা। কিন্তু মাঝে খবর গিয়েছিল তাদের কাছে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে জিতেও যেতে পারে বাংলাদেশ। অনুশীলন থেকে ফিরে ড্রেসিং রুমের টিভি সেটের সামনে গোল হয়ে বসে পড়েন সবাই।
শেষ ওভারে সালমাদের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৯ রান। দুর্দান্ত খেলা রুমানা দ্বিতীয় বলেই চার মেরে এগিয়ে নেন দলকে। তার আগে প্রথম বলে ১ রান নিয়েছিলেন সানজিদা। শেষ চার বলে প্রয়োজন চার। পরের বলে রুমানা এক রান নিলেও পরের দুই বলে দুই আউট।
তিন রান যখন প্রয়োজন তখন দুই ব্যাটসম্যান সানজিদা আউটের পরের বলে রুমানা দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে রান আউট। ফলে বলে প্রয়োজন পড়ে দুই রানের। ঘটনাবহুল শেষ বলে জাহানারা নেমে দুই রান নিলে ড্রেসিং রুমে টিভির সামনে দাঁড়ানো তামিম মাশরাফিরা নেচে ওঠেন। অনেক দিন পর বিজয়ের হাসিতে তামিম, মুশফিকরা ভুলে যান সব। সেই মুহূর্তটি ভিডিও করেন তামিম, যা এখন ভাইরাল।
সদ্য দেরাদুনে অনুষ্ঠিত আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হওয়া বাংলাদেশ দলের দিনকাল মোটেও ভালো না। আসন্ন ঈদটাই মাটি! আফগানিস্তানের মতো এক দলের কাছে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার অনুভব করল কি-না জানা যায়নি যে-বাংলাদেশ কী বাজে কাজটা করেছে। অন্তত একটি ম্যাচ জিতলে মুখ রক্ষা। একটি ম্যাচও যারা জিততে পারে না তাদের এবারের ঈদ কেমন হবে তা নিয়েও সন্দেহের দোলাচাল। লজ্জা পাওয়ার মতো বিষয়। শুধু তামিম, সাকিবরাই নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটই যখন লজ্জায় মাথা অবনত হয়ে পড়েছিল। সেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা যে সম্মান বয়ে এনেছে এতে মাশরাফিদের মুখও উজ্জ্বল হয়েছে। পুরুষদের এশিয়া কাপেও যেখানে মাশরাফিরা কোনো দিন পারেনি। সেখানে মেয়েদের এশিয়া কাপেও বাংলাদেশের মেয়েরা এমন সাফল্য পাবে তা কল্পনাতীত।
কারণ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কান দলের চেয়ে ঢের পিছিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা। সেখানে ওই সব দলকে পেছনে ফেলে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বাজিমাৎ করে দেবে সেটা কে ভেবে রেখেছিল। একসাথে খেলা দেখে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটার মাশরাফি, তামিমরা অভিনন্দন জানান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাসকিন আহমেদ লিখেছেন, ‘আহ কী দারুণ অনুভূতি। আমাদের মেয়েদের অভিনন্দন।’ তাসকিন ছাড়াও মুশফিকসহ আরো অনেক ক্রিকেটার তাদের অনুভূতি জানিয়ে মেয়েদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।
যেখানে ছেলেদের ব্যর্থতায় মুখথুবড়ে পড়েছিল বিসিবি। সেখানে মেয়েদের সাফল্যে তারাও ক্ষাণিকটা নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। এটাও ঠিক, আফগানিস্তানের মতো একটা দলের সাথে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার যন্ত্রণা কী তা ক্রিকেটাররা অনুধাবন করেছেন। বিসিবিও। সেখানে মেয়েদের এমন সাফল্য ঈদের আনন্দ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিবে ক্রিকেটার ও ক্রিকেটপ্রেমীদের।