নির্বাচনের আগে সব দিক সামাল দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টায় মাঠে নেমেছে বিএনপি। দলটি একদিকে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টায় ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে নির্বাচনসংক্রান্ত কৌশল নিয়ে পরামর্শ করতে লন্ডনে গেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বাংলাদেশের জনগণের একাংশের মধ্যে ভারতের ভূমিকা নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে সেটি বদলাতে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নয়াদিল্লি সফরে যাওয়া বিএনপি নেতারা। জবাবে ভারত সুস্পষ্টভাবে কোনো অভিমত ব্যক্ত না করলেও আগামী নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করছে বিএনপি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, মির্জা ফখরুল লন্ডন থেকে ফেরার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করবে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত কারামুক্ত না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না সে প্রশ্নের নিষ্পত্তি ছাড়াও বিএনপির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্য, সর্বোপরি শরিকদের সঙ্গে আসন বণ্টনসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় রয়েছে বিএনপির সামনে।
লন্ডন থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন সামনে থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সব বিষয়েই আলাপ হবে। আগামী দিনের কর্মকৌশল সেখানে অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, অন্য সব ইস্যুর তুলনায় বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং ভারত ও চীনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
যদিও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বর্তমানে বিএনপিকে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। কারণ দলটির বড় অংশই মনে করে, বিদ্যমান বাস্তবতায় ভারতের সমর্থন না মিললেও অন্তত ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা না থাকলে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তারেক রহমানের অনুমতি নিয়ে গত সপ্তাহে ভারত সফরে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির। এ ছাড়া ব্যাংকক হয়ে লন্ডন যাওয়ার পথে ভারতের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মির্জা ফখরুলের বৈঠক হয়েছে বলে একটি সূত্রের দাবি। অবশ্য মির্জা ফখরুল এ ধরনের বৈঠক হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
সূত্র মতে, যদিও ভারতের থিংকট্যাংক বলে পরিচিত অর্গানাইজেশন অব রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ), বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশন, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন, শ্যামা প্রসাদ ফাউন্ডেশন এবং ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিসের উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে অংশ নিতে বিএনপির তিন নেতা সেখানে যান; কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা আগামী নির্বাচন নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এর বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা বৈঠক করেন কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী, বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম লাল, বিজেপি নেতা বিজয় জলিসহ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তবে সফর করে আসা নেতারা ওই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোর কথা স্বীকার করতে চাননি।
জানা গেছে, ভারতীয় রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে বিএনপির নেতারা একটি বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেটি হলো—আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের জনগণের মন জয় করতে পারে ভারত। কারণ বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, গণতন্ত্র তথা নির্বাচনীব্যবস্থা ধ্বংসসহ বর্তমান সরকার যা কিছু খারাপ কাজ করছে সবই ভারতের সহায়তা নিয়ে। বিএনপি নেতারা বলেন, জনগণ মনে করছে, ভারত এই সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে। সুতরাং সরকারের সব কাজের দায় ভারতের ওপর পড়ছে। যেমন খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়া নিয়েও লোকজন সন্দেহ করছে, বুঝি ভারত এর নেপথ্যে আছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চললেও লোকজন মনে করে, ভারত সমর্থন না দিলে সেটি সম্ভব হতো না। অর্থাৎ সরকারের কাজ ও ভূমিকার মধ্য দিয়ে ভারতকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। ভারতকে এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, সরকারের সঙ্গে চুক্তি যতই হোক, জনমনে এ ধরনের ধারণা বজায় থাকলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হবে। তাঁরা বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক টেকসই করতে হলে বাংলাদেশে আগামী দিনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে ভারতের অবস্থান নেওয়া উচিত।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ভারত এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তাই আমরা বলেছি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সব কিছুর জন্য ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত। তাহলে এ অঞ্চলের জনগণের মন তারা জয় করতে পারবে।’ তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের যে সংকট তারা অনুধাবন করছে এবং এটা থেকে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আজকে তারা মনে করছে; এটা একটা ভালো দিক, ইতিবাচক পরিবর্তন।
বিএনপির পরামর্শের জবাবে ভারতের নেতারা কী বলেছেন জানতে চাইলে সফর করে আসা এই নেতা বলেন, ‘তাঁরাও বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে গণতন্ত্রের পথে থাকা উচিত। এ দেশের জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা বোকা নন, এখানকার সব খবরই তাঁরা রাখেন।’ আমীর খসরু আরো বলেন, ‘ভারতও এ দেশে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।’
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘এবার ভারতীয়দের সঙ্গে আলোচনা বেশ ভালোই হয়েছে। আমরা বলেছি, তোমাদের সম্পর্কটা একটি দলের সঙ্গে, একদিকে। এটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব বোঝার জন্য তাদের আমরা প্রয়োজনে টিম পাঠাবার কথা বলে এসেছি। তারা এসে দেখুক এ দেশের মানুষ কী চায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে মিন্টু বলেন, ‘তারা (ভারত) ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের পক্ষে থাকবে না, এটি তারা বলতে পারবে না। কিন্তু আমরা বলেছি যে ফ্রি ফেয়ার ইলেকশনের পক্ষে থাকলে ভারতের লাভ।’
জানা গেছে, সফরকালে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিষয়ে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন নেতিবাচক ভূমিকার কথা ভারতীয়রা উল্লেখ করে। সাতটি রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তখনকার বিএনপি সরকারের নেপথ্য ভূমিকা ছিল বলে ভারত অভিযোগ করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলেন, দুই পক্ষেরই ভুল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতার জন্য তাঁরা ভারতের ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করেন। তাঁরা বলেন, ‘তোমরাও করেছ আমরাও করেছি। কিন্তু অতীতমুখিতা ভুলে এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
আলাপকালে বিএনপি নেতারা ভারতীয়দের এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে বা গণতন্ত্র নস্যাৎ হলে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তাঁরা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে ভারতও ‘ইফেক্টেড’ হবে না এটি বলা যায় না।
ভারতের সঙ্গে তৎপরতা বেশি দৃশ্যমান হলে চীন যাতে বিগড়ে না যায় সেদিকেও দৃষ্টি রাখছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ায় দিন দিন চীন যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলছে তাতে চীনকে বাদ দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকা কোনোটাই সম্ভব নয়। গত ২০ মে কূটনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার পার্টিতে বসার আসনকে কেন্দ্র করে চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপির কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হলে দলটির পক্ষ থেকে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়। বিএনপি সরকারের আমলে ঢাকায় তাইওয়ান সেন্টার নির্মাণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দূরত্বও বিভিন্ন সময় চীনে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে কমিয়ে আনতে পেরেছে বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি এবং বিএনপির রাজনৈতিক গবেষণা সংগঠন জি-নাইনের সাধারণ সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন স্বায়ন্ত সম্প্রতি চীন সফর করেছেন। এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি এবং লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে।
তবে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়ে বিএনপিতে দুই ধরনের মত রয়েছে। একাংশ মনে করছে, দৃশ্যমান যাই দেখাক, ভারত শেষ পর্যন্ত বর্তমান সরকারকেই সমর্থন দেবে। ফলে শুধু ভারতের দিকে বিএনপির ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে ওই অংশের আপত্তি আছে।
অবশ্য লন্ডনে বসে তারেক রহমান নিজেই ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বিএনপির বৈদেশিক নীতি নিয়ে আলোচনা হবে। তবে খালেদা জিয়া মুক্ত না হলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না সে আলোচনা সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে তারেকের সঙ্গে বৈঠকে। একটি সূত্রের দাবি, তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে দেশে নির্বাচনী প্রচারে আনার বিষয়ে দলের একাংশের মত রয়েছে। সেটি নিষ্পত্তি হবে ওই বৈঠকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচন সামনে থাকায় সবদিক বিবেচনায় রেখেই বিএনপিকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। আর এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে মহাসচিব পরামর্শ করতে গেছেন। তাঁর মতে, সব ইস্যু টেলিফোনে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি আমাদের জানানো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কেননা এ দেশে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। ভারত সফরে যাওয়া নেতারা সেই বিষয়টিকেই তুলে ধরেছেন।
সূত্র: কালের কণ্ঠ