দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রবাস জীবনকে ‘গুডবাই’ জানিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছেন শেখ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (৩৭)। চলছে দেশে ফেরার দিনক্ষণ গণনা। বিদেশের সব হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে শিগগির ঢাকার প্লেন ধরবেন তিনি।
শেখ মোহাম্মদ নজরুল বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন বুক ভরা হতাশা নিয়ে। সঙ্গি এখানে গাড়ি চালনা থেকে শুরু করে আরবি ভাষা শেখার মতো আরও অনেক অভিজ্ঞতা। যা হয়তো দেশে তেমন কোনো কাজেই আসবে না তার।
তিনি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে নয়, সৌদি আরব এসেছিলেন পেশাজীবি হিসেবে। কাজ করতেন রিটেইল চেইন সুপার মার্কেট “আল আজিজিয়া পান্ডা’ নামের প্রতিষ্ঠানের এরিয়া কোচ হিসেবে। বাংলাদেশের স্বপ্ন, আগোরা বা মিনাবাজারের তুলনায় বহুগুণ বড় এই প্রতিষ্ঠানের ৩শ’ ৪০টি ষ্টোর রয়েছে গোটা সৌদিজুড়ে।
শেখ নজরুল দেশে ফিরছেন অনিশ্চয়তা আর অস্বস্তি নিয়ে, বলা চলে ফেরা নয়, ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।
সৌদি আরবজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা, সেই সঙ্গে আয়ের সঙ্গে জীবন ধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ক্রমেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দিয়ে প্রথম কর্মজীবনের সব স্মৃতিকে পেছনে ফেলে দেশে ফিরছেন তিনি।
কিন্তু কেন?
সৌদি আরবজুড়ে এখন কাজের ক্ষেত্রগুলোতে চলছে স্থানীয় নাগরিকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠিন শর্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বোঝা চাপানো হচ্ছে বাড়তি করের। ফলাফল কর্মি ছাঁটাই। তিনজনের কাজ একজনকে দিয়ে করাতে হচ্ছে, এতেই বিপত্তি। আর এ কারণে নিজ থেকেই দেশ ছাড়ছেন ঢাকার সাভারের শেখ মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
কেবল নজরুল একা নন, ওই প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে সিনিয়র সিষ্টেম এনালিষ্ট হিসেবে কাজ করা উদ্ধর্তন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেও জানা গেলো চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার শঙ্কা। সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ।
আলাপচারিতায় নিজেরাও জানালেন চাকরি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যায় মাষ্টার্স করা নারায়ণগঞ্জের আইন উদ্দিন শ্যামল (৪২)। ১৬ বছর ধরে কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। তিনিও জানালেন চাকরির বাজারের অস্থিরতার কথা। তার মতে, আগে আয়ের ৫০ ভাগ অর্থ সঞ্চয় করা যেত, এখন ভারসাম্যহীন সবকিছু। সঞ্চয় কমছে, খরচ বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। নিত্যপণ্যে বেড়েছে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর। স্থানীয়দের জন্যে ভর্তুকি থাকলে ভিনদেশিদের ওপর রয়েছে বাড়তি চাপ।
একই পদে কর্মরত ফেনীর জহিরুল হক (৪০) জানালেন আরও ভয়ানক তথ্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় মাষ্টার্স শেষে আইটিতে উচ্চতর ডিপ্লোমা নিয়ে ১৬ বছর আগে যোগ দিয়েছিলেন একই প্রতিষ্ঠানে। “গত সপ্তাহেই আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াই শ’ বিদেশি কর্মি একযোগে ছাঁটাই করা হয়েছে। ছাঁটাইয়ের তালিকা দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে। কে কখন বাদ পড়ে,তা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে চলছে চরম অনিশ্চয়তা। চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ঠিকমতো ঘুমুতেও পারছেন না অনেকে।’
সৌদি সরকার বিদেশি কর্মি নিয়োগে কড়া শর্ত দিয়েছে। কর্মি প্রতি বছরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি ২ হাজার ৪শ’ রিয়াল সরকারকে দিতে হবে। তার মানে জনপ্রতি বাংলাদেশি কর্মির জন্যে বর্তমান মুদ্রা মূল্যমান অনুযায়ী কোম্পানীকে বাড়তি গুনতে হবে ৫৩ হাজার ৬২০ টাকা।
হাজার হাজার কর্মির বিপরীতে সেটা যেমন বোঝা, তার বিপরীতে বিদেশি কর্মির স্থলে স্থানীয়দের নিয়োগ দেওয়া হলে উল্টো ভর্তুকির ব্যবস্থাও রেখেছে সরকার। যে কারণে ব্যয় সঙ্কোচন নীতিতে চলছে ছাঁটাই কার্যক্রম।
‘কর্মক্ষেত্রে শারিরীক ও মানসিক চাপেই আমরা এখন দিশেহারা। এমন পরিস্থিতি যে, এখন দেশে ফিরেও যথাযথ কাজ মিলবে না, বয়সও ফুরিয়ে যাচ্ছে। এমন অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ঢেকে গেছে আমাদের ভবিষ্যত’- যোগ করেন জহিরুল হক।