সকল জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর নাজিব রাজাকের সরকারের অনেক নীতি-সিদ্ধান্ত রিভিউ করলেও বিদেশি শ্রমিকদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এখনো। অথচ নতুন সরকার দেশটিতে অবৈধ অভিবাসীদের ধর-পাকড় শুরু করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশিসহ সাড়ে ৬শ’র অধিক প্রবাসীকে আটক করা হয়েছে।
দেশটির মানব সম্পদ মন্ত্রী এম কুলাসেগারান বলেছেন, এসব অভিবাসীর কাগজপত্র যাচাই শেষে আটক করা হয়েছে। দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে অবৈধ অভিবাসন সমস্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম শেষের দিকে চলে এলেও অনেকেই এখনো অবৈধ আছেন, যাদের হয়তো মালয়েশিয়া ছাড়তে হবে। এমন পরিস্থিতিতেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই বাংলাদেশ সরকারের। এভাবে ক্রমাগত অবৈধভাবে লোক এনে মালয়েশিয়ায় দুই ধরনের সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করেন মালয়েশিয়ায় বসবাসরত অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈধভাবে এসেও অবৈধ হওয়ার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে। কারণ, যে পরিমাণ টাকা খরচ করে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়া আসেন, ভিসার নির্দিষ্ট মেয়াদে সেই পরিমাণ টাকা উপার্জন করা সম্ভব হচ্ছে না বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশির। ফলে, নানানভাবে অবৈধ হতে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশিদের তথ্য অনুযায়ী, পাসপোর্ট ছাড়াই অবৈধ প্রবেশ, ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও অবস্থান, ভিসা যে কোম্পানির নামে সেখানে অবস্থান না করে অন্যত্র কাজ করার অপরাধে প্রতিদিন গ্রেফতার হচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিএমইটি যে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স দেয় সেই কার্ডের কোনো তথ্য হাইকমিশনে দেওয়া হয় না। ফলে প্রতিটি কোম্পানির সংগে যোগাযোগ করে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা ছাড়া হাইকমিশনের উপায় নেই।
অভিবাসন ও জনশক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বাংলাদেশ। ফলে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, কর্মস্থল ও আইন-কানুন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যায় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মালয়েশিয়ায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিদেশি কর্মীদের বিভিন্ন কোম্পানি এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই এজেন্টের কাছ থেকে বাংলাদেশের মালয়েশিয়ান সাব-এজেন্টরা বিদেশি কর্মী সংগ্রহ করেন। এভাবে হাত বদল হতে হতে ভিসার দাম বাড়তে থাকে, যা বাংলাদেশি কর্মীকেই বহন করতে হয়।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়া সরকার জি-টু-জি পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ এবং অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার যে সুযোগ দিয়েছে সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক এর আওতায় নিবন্ধিত হয়েছেন। কিন্তু অনেকেই বৈধ হওয়ার জন্য দূতাবাসের সহযোগিতা না নিয়ে দালালদের খপ্পরে পড়েছেন। মূলতঃ তাঁরাই এখনো সমস্যায় রয়েছেন। অথচ আগামী ৩১ জুন শেষ হয়ে যাচ্ছে অবৈধদের বৈধকরণের এই প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়া সরকার বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক আমদানিতে চরম বিশৃঙ্খলা ও অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কথা বিবেচনা করে জি-টু-জি পদ্ধতি চালু করেছিলো। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকারের দৃঢ়তা না থাকায় তা বেশিদিন টিকতে পারেনি। পরে নানান শর্তে জি-টু-জি প্লাস সংস্করণ চালু হয়। জি-টু-জি প্লাস-এর নিয়ম অনুযায়ী মালয়েশিয়া প্রান্তে কোনো এজেন্ট থাকবে না, শ্রমশক্তির জন্য কোম্পানি সরাসরি চাহিদা দাখিল করবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে কর্মীসংখ্যা নির্ধারণ করে দেবে। ফলে অতিরিক্ত লোক আসার সুযোগ থাকবে না।
তবে বাংলাদেশ প্রান্তে কিছু এজেন্ট থাকবে, যারা ডিমান্ড ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে শ্রমিকদের রিক্রুট করবে এবং সকল কাজ শেষ করে শ্রমিকদের মালয়েশিয়া পাঠাবে। শুরুতে এই পদ্ধতিতে খরচ নির্ধারিত ছিলো ৩৭ হাজার ৫শ’ টাকা; যা পরে বাংলাদেশ সরকারই বাড়িয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক গেলেও ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সোর্স কান্ট্রির স্বীকৃতি পেয়েছে ৬টি সেক্টরের জন্য। থেমে থেমে লোক নিলেও ২০০৬-২০০৭ সালে অতিরিক্ত লোক যাওয়ায় মালয়েশিয়ায় অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
এ কারণে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে লোক আমদানি বন্ধ করে দেয়। কালক্রমে আবিষ্কার হয় জল ও স্থলপথে অমানবিকভাবে লোক পাচারের লোমহর্ষক কাহিনী। তবে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে হাতেগোণা কয়েকজন পাচারকারী শাস্তি পেলেও অন্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। এখনও জলপথে অবৈধভাবে লোক যাচ্ছে, তবে বিমানবন্দর দিয়ে লোক ঢোকানো বন্ধ হয়েছে।