মাঠের বাইরে ঠিক অন্য জগতের মানুষ গেইল

ক্যারিবীয়ান ক্রিস গেইল নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ জারি করে রাখা উচিত যে, লেখা মাঝেমধ্যে শালীনতার সীমানা লঙ্ঘন করতে পারে। আপত্তিজনক মনে হলে দু’তিনটি বাক্য চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। অথবা ফিল্মের মতো শুরুতেই জানিয়ে রাখতে হবে— ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’! অশ্লীলতার দায় এড়িয়ে ক্রিকেটের বর্ণময় ক্যারিবিয়ান চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব!

বিশ্বাস না-হলে চলুন গেলের ইনস্টাগ্রামে। তিন ধরনের ছবির ছড়াছড়ি সেখানে—

১) জাকুজিতে বসে আরাম করছেন গেল। হাতে সিগার। নারী পরিবৃত হয়ে!

২) বিশাল সিংহাসনে বসে আছেন রাজার মতো। অবশ্যই নারী পরিবৃত হয়ে!!

৩) জামাইকায় নিজের বাড়িতে পুল-পার্টি চলছে। সুইমিং পুলের পাশে নাচছেন গেল। অবশ্যই নারী পরিবৃত হয়ে!!!

ইনস্টাগ্রাম থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন? গেলের বাড়িতে? এখানে আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। কোনও ক্রিকেটার নিজের বাড়িতে ‘স্ট্রিপ ক্লাব’ বানিয়েছেন, কেউ শুনেছেন? জামাইকায় গেলের প্রাসাদোপম বাড়িতে রয়েছে। সপ্তাহান্তে সেখানে ক্রিকেটের দলগত বৈঠক হয় না, ‘পোল ডান্স’-এর আসর বসে। এমন নজিরবিহীন আয়োজন নিয়ে গৃহকর্তার কোনও সঙ্কোচ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই তিনি ক্লাবের ক্রিয়াকাণ্ডের ছবি তুলে দিয়ে দুনিয়াকে জানিয়ে দিচ্ছেন।

ক্রিস গেইল কি তবে চিরকুমার? একেবারেই নয়। তিনি বিবাহিত, এক কন্যার পিতাও। মোহালিতে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বোলারদের ঠেঙিয়ে এগারো ছক্কায় সেঞ্চুরি করার পরে দু’হাতে ব্যাট ধরে বাচ্চার দোলনা দোলানোর মতো ভঙ্গি করেছিলেন তিনি। সেঞ্চুরিটা মেয়ে অ্যালিনাকে উৎসর্গ করবেন বলেই এমন ভঙ্গি। মেয়ে এবং স্ত্রী তখন মোহালির ভিআইপি বক্সে বসে।

এ বারের আইপিএলে প্রথমে কেউ তাঁকে কিনতে চায়নি। দু’দিন ধরে বিক্রি না-হওয়ার পরে নিলামের হাট-বাজার গুটিয়ে নেওয়ার অন্তিম লগ্নে বীরেন্দ্র সহবাগের পরামর্শে তাঁকে কিনে নেয় প্রীতি জিন্টার কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। মোহালিতে তাঁর এগারোটা ছক্কার প্রত্যেকটি যেন সশব্দে আছড়ে পড়ছিল নিলাম টেবিলের মাঝখানে ।

আইপিএলের প্রথম বছরে নাইটদের হয়েই খেলতে এসেছিলেন গেল। ভাল কিছু করতে না-পারায় ধৈর্য হারিয়ে তাঁকে বাতিল করে দেয় কেকেআর। নিলামে ওঠা গেল-কে এর পর কেউ কিনল না। জামাইকার সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ানোর সময় তাঁর কাছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের ফোন যায়। চোট পাওয়া এক ক্রিকেটারের বদলি হিসেবে তাঁকে কেনে আরসিবি।

এর পর ৯ বছর ধরে বাকি সব দলকে নিলামের উপেক্ষার পাল্টা জবাব সহ্য করে যেতে হল। আরসিবি-র হয়ে ইডেনে ৫৫ বলে ১০২ করে গিয়েছেন। সাতটি ছক্কা মেরেছিলেন। এ বার নামছেন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের জার্সি গায়ে। কিন্তু উপেক্ষার ইতিহাস তো বদলায়নি। এ বার নিলামে উপেক্ষা দেখানো সাত দলের মধ্যে ছিল যে কেকেআরও!

অন্য কেউ হলে মোহালিতে সেঞ্চুরির পরে নিশ্চয়ই সহবাগের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলতেন, ‘আমার আইপিএল জীবনটা উনি বাঁচিয়ে দিলেন, ধন্যবাদ!’ কিন্তু ক্রিস গেল যে ‘অন্য কেউ’ নন। তিনি নিজেকে ডাকেন ‘ইউনিভার্স বস’ বলে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরই যে শাসক তিনি! মোহালিতে গেল-ঝড় ফিরিয়ে তাই বললেন, ‘‘বীরেন্দ্র সহবাগ আমাকে কিনে আইপিএলকে বাঁচিয়ে দিল!’’

এগারো বছরের আইপিএলে এক বারই তাঁর সাক্ষাৎকারের বরাত পাওয়া গিয়েছিল। কলকাতায় যখন প্রথম বার তিনি খেলতে এসেছিলেন। গিয়ে দেখা গেল, ঘরের দরজা হাট করে খোলা। সাক্ষাৎকার দিতে এলেন তোয়ালে পরে, খালি গায়ে। তাঁর জীবনদর্শনটাই হচ্ছে, নিজের শর্তে বাঁচব। ব্যাট হাতে ক্রিকেট মাঠেও সেই গেল-বাদের প্রতিফলন।

আত্মজীবনীর নাম ‘সিক্স মেশিন’। এ ভাবেই তিনি নিজেকে বর্ণনা করতে ভালবাসেন। ছক্কা মারার যন্ত্র। দেশের হয়ে খুব একটা খেলেন না। কিন্তু টি-টোয়েন্টি লিগের অবিসংবাদী নায়ক। এই বিগ ব্যাশ খেলছেন তো পরক্ষণেই উড়ে যাচ্ছেন পাকিস্তান সুপার লিগ খেলতে দুবাইয়ে। সেটা শেষ করে ভারতে আইপিএল। এখান থেকে তাঁবু গুটিয়ে হয়তো পাড়ি দেবেন বাংলাদেশে। সারা বছর ধরে বিশ্বের কোথাও না কোথাও ঠিক ছক্কা হাঁকিয়ে যাচ্ছেন গেল। কী বলা যায় তাঁকে? ভ্রাম্যমাণ ব্যাটসম্যান?

গেল তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী চলেন। আশেপাশের আবহ তাঁকে প্রভাবিত করতে পারে না। এক বার ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলছে ইংল্যান্ডে। অতিথিদের সম্মানে বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করল এমসিসি। ক্রিকেটের সব চেয়ে পুরাতন, সম্ভ্রান্ত ক্লাবের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট সেখানে তাঁর জামাইকা সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা শুরু করলেন। সমুদ্র, পাহাড়, ঝর্নায় ঘেরা জামাইকা কী অসাধারণ! একটানা বলতে বলতে শ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন ব্লেজার-টাই পরিহিত এমসিসি শীর্ষ কর্তা। তৎক্ষণাৎ গেলের প্রশ্ন, ‘‘জামাইকার মেয়েদের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করলেন? কেমন লাগল?’’ নৈশভোজের আসরে তখন পিন পড়লেও শোনা যাবে!

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন কোনও ব্যাটিং রেকর্ড আছে, যা তাঁর দখলে নেই? দশ হাজার রান পেরিয়ে গিয়েছেন অনেক আগে। তাঁর একার যত সেঞ্চুরি, বিরাট কোহালি, এ বি ডিভিলিয়ার্স, ব্রেন্ডন ম্যাকালামের মিলিত ভাবেও নেই। আইপিএলে ৩০ বলে সেঞ্চুরি আছে। সর্বোচ্চ রান ১৭৫। এক ওভারে ৩৭ রান নেওয়ার অসম্ভব কাজও করেছেন তিনি (একটি বল ‘নো’ হয়েছিল)।

কী ভাবে থামানো যায় গেলকে? এ রকমই একটা দ্বৈরথের আগে এক বার ওয়াসিম আক্রমকে জিজ্ঞেস করা গিয়েছিল। আক্রম তখন কেকেআরের বোলিং কোচ। আর ক্রিস গেল আরসিবি-র হয়ে ওপেন করতে আসছেন। আক্রম শুরু করলেন, ‘‘অফস্পিনার আনলে কাজ হতে পারে। বাঁ-হাতি গেলকে দেখেছি, বাইরের দিকে যাওয়া স্পিনে কিছুটা সমস্যায় পড়ে।’’ তার পরেই বোধ হয় আক্রমের মতো কিংবদন্তি বোলারের চোখের সামনেও সেই ছবিটা ভেসে উঠল ক্রিজে দাঁড়িয়ে সব বোলারকে গদা হাতে চুরমার করছেন ক্রিস গেল। দ্রুত আক্রমের সংযোজন, ‘‘ভিডিয়ো বিশ্লেষণ আছে ঠিকই। কিন্তু সব উড়িয়ে দিতে গেলের লাগবে দশ বল। দশ বল মানে ৬০ রান!’’

এখন আক্রম নেই, বোলিং কোচ জিম্বাবোয়ের প্রাক্তন মিডিয়াম পেসার হিথ স্ট্রিক। কেকেআর গেলেরই সতীর্থ সুনীল নারাইন বা কুলদীপ যাদবের রহস্য দিয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে পারে। গেল-ঝড় থামাতে গেলে আর একটা জিনিস লাগবেই প্রার্থনা!