ধরুন, আপনার দেশ শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশসমূহের হুমকির সম্মুখীন। বাণিজ্য অবরোধে টালমাটাল। আকাশসীমা ব্যবহারের ওপরও বিধিনিষেধ। এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, এমনটা প্রত্যাশা নিশ্চয়ই আপনার মাথায়ও আসবে না। কিন্তু অন্তত একটি ক্ষেত্রে তীব্র অবরোধের এমন অদ্ভুত ফলাফলই দেখা গেছে।
পারস্য উপসাগরীয় অ লের ক্ষুদ্র দেশ কাতারের ওপর বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সর্বমুখী অবরোধের এক বছর ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অবরোধের ফলে কাতারের অর্থনীতির ওপর যেই বিপজ্জনক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছিল, তা শুধু এড়াতেই সক্ষম হয়নি দেশটি; বরং, দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।
মিশর, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে আরোপিত ভূ, আকাশ ও সমুদ্র অবরোধকে একত্রে বলা হয় কাতার সংকট। পুরো অবরোধের উদ্দেশ্য ছিল কাতারের অর্থনীতিকে ভেঙ্গে দেওয়া। পাশাপাশি, কাতারের আমিরকে সৌদি আরবের একগুচ্ছ দাবি মেনে নিতে বাধ্য করা। এই দাবিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, উপসাগরীয় অ লে সৌদি নেতৃত্ব মেনে চলা, প্রভাবশালী টিভি স্টেশন আল জাজিরা বন্ধ করা এবং সৌদি আরবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা।
তবে মাত্র ২৫ লাখ জনসংখ্যার এই ক্ষুদ্র দেশটি একটি দাবিও মানতে রাজি হয়নি। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (৩২) চাপের মুখে কাতারের ৩৭ বছর বয়সী আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি নতি স্বীকার করেননি।
এই সংকটকে অনেকেই বলেছেন উপসাগরীয় যুদ্ধের পর আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিভেদ। অবরোধের একেবারে শুরুর দিকে কাতারিরা তড়িঘড়ি করে সুপারমার্কেটে হানা দিতে থাকেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, প্রতিবেশী দেশগুলোর অবরোধের কারণে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এছাড়াও কাতারের পুঁজি বাজারে ধস নামে।
এমনকি সৌদি সামরিক হামলার আশঙ্কাও জোরদার হতে থাকে। যদিও কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থাকায় সৌদি হামলার সম্ভাবনা বেশ কমই ছিল। এক পর্যায়ে সংকট সমাধানে তুরস্কের দ্বারস্ত হয় দোহা। তুরস্ক কাতারে সেনা পাঠায়। ইরান ও তুরস্ক মিলে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী পাঠায়। শুরুর কয়েক মাসে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে আকাশসীমা লঙ্ঘণের অভিযোগ তোলে। উত্তাল ওই পরিস্থিতিতে কাতারের রাজপরিবারের এক শেখের নিখোঁজ হওয়া, কাতারকে স্রেফ দ্বীপে পরিণত করা, কাতার সীমান্তকে সামরিক অ ল ও পারমাণবিক বৈর্জ্য অপসারণস্থলে পরিণত করার সৌদি পরিকল্পনার কথাও খবরে এসেছে।
প্রথম কয়েক সপ্তাহে, পূর্বের বছরের তুলনায় কাতারের আমদানি ৪০ শতাংশ হ্রাস পায়। কিন্তু এই এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, আমদানি পরিস্থিতি একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছেছে।
সংকট শুরু হলে বিশ্বের তরলীকৃত গ্যাসের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক কাতার নতুন বাণিজ্য পথ খোঁজার কাজ হাতে নেয়। পুঁজিবাজার ও আর্থিক ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন ব্যাংকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থ সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ঘরোয়া বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে পারে, সেজন্য সহায়তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু তা-ই নয়। পারস্য উপসাগরে ইরান ও কাতারের যেই যৌথ গ্যাসক্ষেত্র আছে, সেটি বিশ্বের বৃহত্তম। সেই গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের কাজও ত্বরান্বিত করতে থাকে কাতার।
মার্চে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথমদিককার সংকট সামলে উঠেছে কাতারের ব্যাংকিং সিস্টেম। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ২.৬ শতাংশ, যা ২০১৭ সালের চেয়েও বেশি! এমনকি দেশের রাজস্ব ঘাটতিও কমে জিডিপির ৬ শতাংশে নেমে আসবে। অথচ, ২০১৬ সালেও এই ঘাটতি ছিল ৯.২ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি দূরে থাক, উল্টো উন্নতি হয়েছে।
মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম ফোর্বস বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান এইচএসবিসি’র বরাতে লিখেছে, কাতারের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৯০ কোটি থেকে ১৭৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এইচএসবিসি লিখেছে, কাতারের এই শক্তিশালী অবস্থানের আংশিক কারণ হলো, দেশটি বাণিজ্য ভারসাম্যের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবেই ভালো করছে।
কাতারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার ইস্যুতে সমালোচনা জারি রয়েছে। বিশেষ করে, দেশটির বিদেশী শ্রমিক নিয়োগের নীতিমালা, তথা কাফালা সিস্টেমের কারণে বিদেশী শ্রমিকরা ভীষণ বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সিস্টেমকে অনেকেই আধুনিক যুগের দাসত্ব ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ কারণে মানবাধিকার গোষ্ঠীসমূহ অনেক দিন ধরেই কাতারে অনুষ্ঠেয় ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ বয়কটের দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ, এই বিশ্বকাপ আয়োজনে নতুন যেসব স্টেডিয়াম নির্মান করছিল কাতার, সেখানে কাজ করেছে বহুসংখ্যক বিদেশী শ্রমিক। আর এসব স্থাপনা নির্মানে শ্রমিক মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন স্টেডিয়াম নির্মানে কাজ করতে গিয়ে প্রায় ১২০০ শ্রমিক মারা গেছেন।
এছাড়া কাতারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজপরিবার ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা ও সীমিত নাগরিক স্বাধীনতা নিয়েও অনেকে সোচ্চার ছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে দেশটির। ২০১৯ সালে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে উন্মুক্তভাবে ভোট দিতে পারবেন নারী ও পুরুষ ভোটাররা, যদিও পার্লামেন্টের তেমন ক্ষমতা নেই।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিজেদের ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১৮-এ কাতারের অগ্রগতির প্রশংসা করেছে। ২০১৭ সাল জুড়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়ন করায় কাতারকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, এসব সংস্কার পুরোদমে বাস্তবায়িত হলে কাতারের মানবাধিকারের মানদ- হবে উপসাগরীয় অ লে সবচেয়ে প্রগতিশীল।
এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য নতুন মানদ-, গৃহকর্মী আইন, পিতা বিদেশী হলেও কাতারি মায়েদের সন্তানদেরকে স্থায়ী বাসিন্দা সুবিধা প্রদান করা, বিদেশী কিছু বাসিন্দাকেও স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র দেওয়ার বিধান, ইত্যাদি।
বিশ্বের সবচেয়ে বিনিয়োগ হওয়া দেশগুলোর একটি কাতার। আয়তনে দেশটি এত ছোট। অথচ বিশ্ব রাজনীতিতে দেশটির রয়েছে ব্যপক প্রভাব। এর বড় কারণ হলো, জ্বালানি খাত থেকে যেই বিপুল হাজার হাজার কোটি ডলার রয়েছে দেশটির, তা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশটির জাতীয় তহবিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বৈশ্বিক রিয়েল এস্টেট খাত ও বৃহৎ কিছু কোম্পানিতে এসব অর্থ বিনিয়োগ করা। লন্ডনে এমনকি কাতারি কোয়ার্টারও রয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে বিনিয়োগের বিপরীতে এখন প্রতিদান চায় কাতার। দেশটি আর্থিক কিছু সংস্কারও এনেছে। যেমন, কাতারে কার্যক্রম রয়েছে এমন কোম্পানিগুলোতে এতদিন কাতারি মালিকানা কিছুটা হলেও থাকতে হতো। এখন পূর্ণ বিদেশী মালিকানাও মেনে নেওয়া হবে। সৌদি আরব সম্প্রতি যেই সীমিত সংস্কার এনেছে, সেই তুলনায় একে বেশ উদারই বলা চলে। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরকে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, এমনকি আয়কর থেকেও অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে আরও উন্মুক্ত করার প্রয়াসের অংশ এই পদক্ষেপ।
সৌদি-আমিরাত অবরোধের বিরুদ্ধে কাতারের প্রতিরোধের আরেকটি কৌশল ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে লোভনীয় অস্ত্র চুক্তি সম্পাদন করা। নিজেদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, নব্বইয়ের দশকে আমেরিকার আল উদেইদ বিমান ঘাঁটি নির্মানে প্রায় ১০০ কোটি ডলার দিয়েছিল কাতার। এই ঘাঁটি থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড পরিচালিত হয়। এখানে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীও সক্রিয়।
সৌদি আরব যখন প্রথম অবরোধ আরোপের ঘোষণা দেয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাতে সমর্থন জানান। তিনি টুইটারে লিখেন, কাতার বেশ উঁচু পর্যায়ে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক। তার এই বক্তব্যে খোদ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চমকে উঠে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন উত্তেজনা হ্রাসের চেষ্টা করছিল।
তবে ওই সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২০০ কোটি ডলারের যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চুক্তি করে কাতার। এমনকি দুইটি মার্কিন রণতরী কাতারের সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে উপস্থিত হয়। আরও কয়েক মাস পর, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কাতার ১২০০ বিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান ও সাঁজোয়া যান ক্রয়ের ঘোষণা দেয়।
এছাড়া প্রায় এক বছর ধরে ওয়াশিংটনে নিজের ইমেজ বৃদ্ধির কাজে মনোযোগী হয়েছে কাতার। এমনকি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মালিকানাধীন ডানপন্থী সংবাদমাধ্যম নিউজম্যাক্স কিনতেও আলোচনা শুরু করে কাতার।
তবে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও হামাসের সঙ্গে কাতারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি একেবারেই যে মিইয়ে গেছে, তা নয়। তবে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ এত তীব্র যে, কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তেমন কিছুই নয়।
কাতার সংকট শিগগিরই দ্বিতীয় বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছে। তবে এই সংকট শিগগিরই সমাধা হবে, এমন সম্ভাবনা কম। তা সত্ত্বেও, কাতারের অর্থনীতি ও দেশটির বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকারের অগ্রগতিতে এই সংকট তেমন প্রতিবন্ধকতা তো সৃষ্টি করতে পারেইনি, বরং দৃশ্যত ইতিবাচক ভূমিকাই রেখেছে।