মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক বৈঠকের সাক্ষী হতে উপস্থিত থাকতে পারেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন। বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উত্তর কোরিয়া সফরের পর উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। বৈঠকের আলোচনার মধ্যেই দুইবার চীন সফর করেছেন কিম জং উন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও পিয়ংইয়ং সফর করেছেন
শিফারুল শেখ
আগামী ১২ জুন সিঙ্গাপুরে বহুল আলোচিত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত এক বৈঠক হওয়ার কথা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের মধ্যে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক বৈঠকের সাক্ষী হতে উপস্থিত থাকতে পারেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন। বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের উত্তর কোরিয়া সফরের পর উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। বৈঠকের আলোচনার মধ্যেই দুইবার চীন সফর করেছেন কিম জং উন। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও পিয়ংইয়ং সফর করেছেন। গত মাসেই উত্তর কোরিয়া সফর করেছেন ভারতের এক মন্ত্রী। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর নজর এখন উত্তর কোরিয়ার দিকে। সবাই ব্যস্ত তাদের স্বার্থ রক্ষায়।
উত্তর কোরিয়ার সাবেক গোয়েন্দা প্রধান এবং কিম জং উনের ডানহাত বলে পরিচিত কিম ইয়ং চোলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিও এবং পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছে। কিন্তু এরই মধ্যে মাইক পম্পিও বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং কিম জং উনের মধ্যে বৈঠক হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে দুই দফা উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন মাইক পম্পিও। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ১২ জুন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠেয় বৈঠক নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ৭২ ঘণ্টায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়। আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা ঠিক যে আলোচনা ইতিবাচক দিকেই যাচ্ছে। তবে সিঙ্গাপুরে এবং উত্তর কোরিয়ার অসামরিক এলাকার বৈঠকগুলো সম্পর্কেও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, দুই দেশই একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছে। কোনোভাবেই যেন এই সুযোগ নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আমি প্রথম বৈঠকেই কাজ শেষ করতে চাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এভাবে চুক্তিতে উপনীত হওয়া যায় না। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বৈঠকেও একটি চুক্তি না হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে নিশ্চিয়ই একমত হওয়া যাবে। ট্রাম্প শুক্রবার কিম জং উনের একটি চিঠি পেয়েছেন। ঐতিহাসিক পরমাণু অস্ত্র বিষয়ক সম্মেলনের পদক্ষেপকে এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চিঠিটি পাঠানো হয়। ট্রাম্পকে কিমের চিঠি পাঠানোর বিষয়টি, নির্ধারিত ১২ জুনের সম্মেলন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রকৃত অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন মার্কিন কূটনীতিকরা। এরই মধ্যে শুক্রবার সম্পর্ক উন্নয়নের চলমান প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করতে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করেছে।
পথ মিলেছে পিয়ংইয়ংয়ে
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম তার দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পরমাণু অস্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে তাদের যাতে ক্ষতি না হয় সেই চেষ্টাও শুরু হয়েছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পিয়ংইয়ং যেতে শুরু করেছেন। সবাই বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। যদিও ২০১৫ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুসারে বিশ্বে উত্তর কোরিয়া আমদানি-রপ্তানিতে তালিকার ১০০ তেও নেই।
বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের সীমান্ত এলাকা ১ হাজার ৪২০ কিলোমিটার। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় মিত্র। চীন কখনোই চাইবে না যে কোরীয় উপদ্বীপে কোনো ধরনের যুদ্ধ বাধুক। গ্রিফিত ইউনিভার্সিটির গ্রিফিত এশিয়া ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো ড. পিটার লেটন মনে করেন, চীন এখনো গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। কিন্তু কখনোই নিয়ন্ত্রণ করেনি। অনেকে বলেন, চীন উত্তর কোরিয়াকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এই বিষয়টিও কিন্তু নিশ্চিত নয়। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু প্রকল্পের ওপর চীনের কতটুকু প্রভাব আছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পরমাণু প্রকল্প বন্ধে অবরোধ কাজ করতে পারে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে কোরীয় উপদ্বীপের ঘটনার সময়কার চীন এবং এখনকার চীন এক নয়। সেই সময় চীন বসে থাকতো যুক্তরাষ্ট্র কী বলে তার দিকে। কিন্তু এখন উত্তর কোরিয়ার ওপর চীনের যে প্রভাব আছে তা হয়তো অন্য কোনো দেশের ওপর নেই। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. লিওনিড পেট্টভ বলেন, চীন উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যের ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তারা উত্তর কোরিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে না। চীন চায় উত্তর কোরিয়া সহযোগী হয়ে থাকুক। ২০১৫ সালে চীন উত্তর কোরিয়ার ৮৩ ভাগ পণ্য আমদানি করে এবং উত্তর কোরিয়ায় রপ্তানি করে ৮৫ ভাগ। ২০১৬ সালে রপ্তানির পরিমাণ ৯০ শতাংশে পৌঁছায় যার আর্থিক মূল্য ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
রাশিয়াকে অবজ্ঞা নয়
ট্রাম্প ও কিম জং উনের সম্ভাব্য সফরের আগে কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করছে বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে রাশিয়া অন্যতম। বৃহস্পতিবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কিম জং উনের বৈঠক হয়। মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার কাছে নালিশ করেছেন কিম। এই নালিশ সম্ভাব্য ট্রাম্পের সঙ্গে তার বৈঠককে আরো জটিল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কিম জং উন বলেন, মার্কিন আধিপত্যবাদের মুখে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা আপনার নেতৃত্বে বিশদ ও গভীর আলোচনায় ইচ্ছুক। ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো পিয়ংইয়ং যান ল্যাভরভ। সফরে তিনি উত্তর কোরীয় নেতাকে রাশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানান। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ইস্যুর শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে ছয় জাতির আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত রাশিয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, ল্যাভরভ তার সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে এই বার্তা দিলেন যে রাশিয়াকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না। কারণ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তার সক্ষমতাকে দেখাতে কোনোভাবেই ভুল করবেন না। এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব কমানোও এই সফরের লক্ষ্য। দুই বছর আগে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া ‘বন্ধুত্বের বছর’ হিসেবে পালন করে। ২০১১ সালে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে ১০ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ মওকুফ করে দেয়। কারণ রাশিয়ার তেল সরবরাহে উত্তর কোরিয়া গুরুত্বপূর্ণ রুট। ২০১৬ সালে রাশিয়া উত্তর কোরিয়া থেকে ৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। মূলত এশিয়ায় উত্তর কোরিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের কথাও শোনেনি ভারত
গত মাসের মাঝামাঝিতে ভারত জানায়, সেদেশের একজন মন্ত্রী উত্তর কোরিয়া সফর করেছেন। এর আগে ১৯৯৮ সালে ভারতের কোনো মন্ত্রী দেশটিতে সফরে যান। এবারের সফরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক, আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতও চেয়েছে, তারা যাতে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কূটনীতিতে পিছিয়ে না থাকে। ২০১৩ সালে ভারত চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পর তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছিল। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৪ সালে যেখানে ২শ’ মিলিয়ন বাণিজ্য ছিল সেখানে এখন ১৩০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত সবসময় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। গত বছর তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ করতে বলেও ভারতে তাতে রাজি হয়নি। ২০১৬ সালে ভারত ৮৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য উত্তর কোরিয়া থেকে রপ্তানি করে।
অন্যান্য দেশের স্বার্থও কম নয়
পাকিস্তান, মালয়েশিয়া এবং বুলগেরিয়াও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এছাড়া ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া থেকে অন্যান্য দেশ পণ্য আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে ফিলিপাইন ৫১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের (উত্তর কোরিয়ার মোট রপ্তানির ১ দশমিক ৮ ভাগ), তাইওয়ান ১২ দশমিক ২ মিলিয়ন (দশমিক ৪ ভাগ), ফ্রান্স ১১ দশমিক ৪ মিলিয়ন (দশমিক ৪ ভাগ) মোজাম্বিক ১০ দশমিক ৯ মিলিয়ন (দশমিক ৪ ভাগ), ব্রাজিল ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন (দশমিক ৩ ভাগ), বুরকিনা ফাসো ৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন (দশমিক ৩ ভাগ), মেক্সিকো ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন (দশমিক ২ ভাগ), জার্মানি ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন (দশমিক ২ ভাগ), তুরস্ক ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন (দশমিক ২ ভাগ), সৌদি আরব ৬ দশমিক ১ মিলিয়ন (দশমিক ২ ভাগ), মিসর ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন (দশমিক ২ ভাগ), চিলি ৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের (দশমিক ২ ভাগ) পণ্য আমদানি করে। ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়ার রপ্তানির ৯৮ দশমিক ২ ভাগ গেছে এসব দেশে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে বুরকিনা ফাসো (১৫ হাজার ৬৫ ভাগ), মোজাম্বিক (১ হাজার ২৭৩ ভাগ), ভারত (১ হাজার ২৩৭ ভাগ) এবং চিলি (৫১৩ দশমিক ২ ভাগ)।