উন্নত দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের ঈদ আনন্দের চিত্র কিছুটা ভালো হলেও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের ঈদ আনন্দ অনুভূতি থাকে অন্যরকম। প্রবাসীদের বেশিরভাগেরই নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে কাটে ঈদ। তারা মনে করেন, পরিজন ছাড়া কোনো ঈদ খুশির হয় না।
সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রত্যেক পরিবারেরই প্রায় কোনো না কোনো সদস্য প্রবাসে রয়েছেন। এ কারণে ঈদসহ নানা উৎসবে তাদের শূন্যতা ভোগেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকটা শুভেচ্ছা আদান-প্রদান সহজ হলেও মনপ্রাণ পড়ে থাকে স্বজনদের কাছে। আবার দেশের অভিভাবকরাও অনুভব করে সন্তানের চরম শূন্যতা। বিভিন্ন প্রবাসী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে তুলে ধরা হয়েছে প্রবাসীদের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের নানা দিক।
সিলেট নগরীর মইয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা লিলি তালুকদার। বড় ছেলে মিফতাহ উদ্দিন স্টুডেন্ট ভিসায় ইউকেতে পাড়ি জমায় ৫-৭ বছর আগে। এখন দুই ছেলে ও এক মেয়ে লন্ডনে, এক ছেলে কানাডায় চলে গেছে। তাই আনন্দ নেই মা লিলি তালুকদারের মনে। অনুভূতি জানাতে গিয়ে বললেন, সবসময় মন পড়ে থাকে সন্তানদের কাছে। মাত্র কয়েক বছরে যেন পুরো ঘর শূন্য হয়ে গেছে তার।
যুক্তরাজ্যে রাজ্যের কার্ডিফের বর্তমান বাসিন্দা লিজা আক্তার। স্বামী ও মেয়ে নিয়ে কিছু দিন আগে দেশ ছেড়েছে তারা। দেশের বাইরে প্রথম ঈদ তাদের। লিজা বলে, প্রবাসের ঈদ এতো ফ্যাকাসে হয় কখনো জানা ছিল না। ঈদ আনন্দ মানেই পরিবার। বাবা-মা-ভাই বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি। প্রবাসে এসে বুঝতে পেরেছি, আমাদের ঈদ ঈদ নয়; যেন বেদনা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাই প্রবাসী মাসুম। ভিজিট ভিসায় গিয়ে বৈধ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ধরতে চেয়েছিলেন ‘সোনার হরিণ’। কার্যত কিছুই হয়নি তার। অবৈধতার সুযোগে মালিক কাজ করিয়ে টাকা দেয় না। তাই ঈদের পরিবারকে টাকা দেয়া হয়নি তার। মাসুম জানালেন, এর জন্য নিজ থেকে ঈদের দিন সকালে ফোন দেননি তিনি। দেশ থেকে বাবা-মা ফোন দিয়েছিলেন। কথা হয়েছে। তখন তিনি কাজে ছিলেন, তবে তা বাবা-মাকে বুঝতে দেননি।
কাতার প্রবাসী আলী হোসেন বলেন, স্বজনদের দূরে রেখে আবার কিসের ঈদ। ঈদের সারাদিন ঘুমের মধ্যেই কাটে তার। দুই দেশে দুই দিনে ঈদ হওয়ায় এমনিতেই কিছুটা ভিন্নতা থাকে। ঈদের দিনে অনলাইনে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা হয়। আর এর মাধ্যমেই কিছু কষ্ট দূর করার চেষ্টা করি।
ওমান প্রবাসী সজিব আহমদ জানালেন, মেসে একসাথে ১৫ জন প্রবাসী থাকেন। এদের কেউই পিঠেপুলি বানাতে পারদর্শী নয়, এরজন্য খাওয়া হয়নি। সবসময় যা রান্না করেন তাই দিয়েই কেটে গেছে ঈদের দিন। সেলিম আহমদ নামের অপর প্রবাসী জানান, দেশে তার ছোট ছোট তিনটি ছেলে রয়েছে। ফজরের নামাজের পরপরই দেশে ফোন করেছেন। কথা বলেছেন তাদের সাথে। খোঁজ নিয়েছেন জামা কাপড় কেমন হয়েছে। এরপর তিনি কাজে চলে গেছেন।
সিলেট কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্ণি গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। নিজেও একসময় ছিলেন প্রবাসী। ছোট ভাই আজিজুর রহমান ছিলো সৌদি আরবে। আকামা জটিলতায় মাসখানেক ধরে সে সৌদি কারাগারে। ঈদের আগে দেশে ফিরবে ফিরবে বলে ফিরেনি। মা অপেক্ষায় থাকেন প্রতিনিয়ত ছেলের জন্য। ঈদ আসলেও আনন্দ নেই তাদের ঘরে।
সিলেট শহরতলীর নোয়াখুররমখলা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো। একে একে সবাই বিদেশে চলে যাচ্ছে। ঈদের দিনে ফোন দিলে বলে কাজে। খারাপ লাগে। যারা আমাদের মুখে আনন্দের হাসি ফুটানোর জন্য নিজের আনন্দ বিসর্জন দেয়।
এর বিপরীতে কুয়েত প্রবাসী মিনহাজ আহমদ বলেন, যেখানে হৈ-হুল্লোড় করে কেটে যেতো ঈদের দিন। সেখানে অনেক বন্ধু মনেই রাখে না তাদের। প্রবাসী কেবল ঈদের আনন্দ কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে অনেক বন্ধুও।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন হোসেন বলেন, আমাদের এখানের ঈদ হলো ফোনে বা ভিডিও কলে মায়ের সাথে দুয়েক মিনিট কথা বলা। পরিবারের সকলের সাথে হাসিখুশিতে কথা বলে আবার কাজে লেগে যাওয়া। আসলে পরিবার পরিজন ছাড়া কোনো ঈদ খুশির হয় না।
সিলেট সদর উপজেলার কান্দিাগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা হাজী আব্দুন নূর বলেন, প্রবাসের ছেলেরা বিদেশে থেকে টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের সুখে রাখার চেষ্টা করছে। তারা আমাদের কষ্ট ভুলিয়ে রাখতে চায়। আসলে তারা জানে না, আমরা বাবা-মায়েরা যে তাদের ছাড়া ভালো থাকতে পারি না। তিনি প্রবাসের সকলের জন্য মঙ্গল কামনা করেন।
অন্যদিকে প্রবাসীরা বলছেন, জীবিকার তাগিদে তারা দেশ ছেড়ে প্রবাসে গেছেন। তাদের পরিবারের উন্নত জীবনের পাশাপাশি রেমিটেন্সের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নেও তারা অবদান রাখছেন। দেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের মুখে হাসি দেখে তারা সব কষ্ট ভুলে যান। স্বজনদের আনন্দই তাদের কাছে ঈদের আনন্দ। সব প্রবাসীরা ভালো থাকুক এমন প্রত্যাশা দেশে অবস্থান নেওয়া স্বজনদেরও।
সূত্র : রাইজিংবিডি