রিজভীর মাসে ৩০ ব্রিফিংয়ের রহস্য ফাঁস!

ছোট্ট কক্ষ, ৫ বাই ৩ ফুট। প্রায় পুরোটা জুড়ে একটি খাট-টেবিল। বাকি জায়গাটুকুতে বই আর বই, স্তূপাকার। কি নেই এই তালিকায়? হাসানের স্বাধীনতার পথ থেকে শামসুজ্জোহার শিকল পরা স্বাধীনতা। এরিস্টটলের পলিটিকস যেমন রয়েছে, আছে অধ্যাপক শেখ সাইয়েদুল ইসলামের জাত প্রথা নিপাত যাক।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ কিন্তু ঠিকই শোভা বাড়িয়েছে। তৈমূর আলম খন্দকারের রাজনীতির ভগ্নাংশ, তরুণ কবি জুন্‌নু রাইনের এয়া, হেমন্ত গঙ্গোপ্যাধায়ের চার্বাক দর্শন তাতে যোগ করেছে আলাদা দ্যুতি।

নোয়াম চমস্কির ভবিষ্যৎ নির্মাণ মেকিং দ্য ফিউচার আপনাকে যেমন পথ দেখাবে, এ এন এম সিরাজুল ইসলামের রমযানের তিরিশ শিক্ষাও জীবনে দিশা হবে।

পুরো কক্ষটি দেখে মনে হবে, কোনো জ্ঞান তাপসের নিরন্তর সাধনার আখড়া। এলোমেলোভাবে পড়ে থাকলেও বইগুলো ঠিকই জানান দিচ্ছে, কারও অবহেলা নয়, মাত্রই তাকে কেউ স্পর্শ করেছে।

হ্যাঁ, এমন কক্ষটি রাজধানীর ব্যস্ততম নয়াপল্টনে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আরও স্পষ্ট করলে দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কক্ষ। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এই কক্ষকেই তিনি ঘরবসতি মানছেন।

কার্যালয়ে স্থায়ী হয়ে যাওয়ায় সমালোচকরা রিজভীকে বিএনপির ‘আবাসিক নেতা’ বলেও টিপ্পনি কাটেন! তবে, সবচেয়ে যেটি আলোচনায় এসেছে, নিয়ম করে হররোজ তার ব্রিফিং। লিখিত বক্তব্যে রিজভী ভাষার জাদু দেখান।

তার নূতন নূতন শব্দের অর্থ খুঁজতে প্রায়ই সংবাদকর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। বাধ্য হয়ে অনেকেই রিজভীর কাছ থেকেই সেটির অর্থ জেনে নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনিও সহাস্যে সেটি জানিয়ে বেশ গর্বিতবোধ করেন!

রিজভী বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব হলেও একহাতে সামলান দপ্তর। পরপর দু’বার এই দায়িত্বে আছেন। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় দিবস, দলের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন, শোকবার্তা— সবই তার ড্রাফটে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়।

এর বাইরেও প্রত্যেক দিন রিজভী ব্রিফ করেন। লিখিত ব্রিফিংয়ের সেই সফট কপি সংবাদকর্মীদের আগেই সরবরাহ করা হয়। কারণে-অকারণে তার এই ব্রিফকে এখন দলের ভেতরে-বাইরের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছেন। অনেক সময় এ নিয়ে সৃষ্টি হয় হাস্যরসের।

প্রশ্ন উঠেছে, রিজভী শুধু ব্রিফ করে দায় সারছেন। তার এই অতিমাত্রার ব্রিফিং এখন অনেকের বিরক্তির কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে।

তবে, বিএনপি নেতাদের একাংশ মনে করেন, তা কেন? রিজভীই একমাত্র নেতা যিনি সুযোগ পেলেই রাজপথে নেমে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করছেন।

এই অংশের দাবি, বিএনপির চরম দুসময়ে যখন কথা বলার মতো কোনো নেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি, তখন তিনিই সরকারবিরোধী নানা ইস্যুতে সরব ছিলেন, রয়েছেন।

সবকিছুকে উপেক্ষা করে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে বিএনপি কার্যালয়ে অবস্থান করছেন রিজভী। পরিবার-পরিজন ছেড়ে রাজনীতির জন্য এমন ত্যাগ কতজনই পারে, এমন মতও দলের ভেতরে বেশ চাঙ্গা।

জানা গেছে, বিগত এক বছর রিজভী স্বেচ্ছায় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। দাপ্তরিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে কার্যালয়ের ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করেন।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এই ছাত্রনেতা কার্যালয়ে আসা নেতাকর্মীদের সময় দেন, তাদের সুখ-দুখের কথা শোনেন। বাকি সময় বই পড়েই কাটান। দুটি ঈদও এখানেই কাটিয়েছেন।

খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না। কার্যালয়ের স্টাফদের জন্য যে রান্না হয়, তা থেকেই সেরে নেন। এর বাইরে নিয়মিতই পরিবারের সদস্য ও নেতাকর্মীরা খাবার নিয়ে আসেন।

দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থাকা রিজভী স্ত্রী আঞ্জুমান আরা আইভী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের খুব মিস করেন বলে জানান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) ভিপি থাকাকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী রেলস্টেশনে গুলিবিদ্ধ হন রিজভী। তখন থেকেই তিনি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।

বগুড়ার সন্তান ছাত্রদলের সাবেক এই সভাপতি কার্যালয়ে তার অবস্থানের বিষয়ে বলেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমি কার্যালয়ে অবস্থান করছি। তিনি মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান অব্যাহত থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘এর বাইরে আমার নামে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এজন্য কার্যালয়ে বসেই দলীয় কার্যক্রম করতে হচ্ছে।’

তবে, একেবারে যে বাইরে যাচ্ছি না এমন না। কার্যালয়ের সামনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। পুলিশের উপস্থিতি কম থাকলে সুযোগ বুঝে প্রতিবাদ মিছিল করছি, যোগ করেন রিজভী।

সময় কিভাবে কাটে— এমন প্রশ্নে তিনি জানান, খুব ভোরে ওঠার চেষ্টা করি। পরে তিনতলার সংবাদ সম্মেলন কক্ষে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। নাশতা শেষে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত দলীয় কর্মকাণ্ড করি। এর মাঝে বড় যে সময় পাই, উপন্যাস, কবিতা, সাহিত্য আর রাজনৈতিক বই পড়ি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হলে, ওইদিন থেকেই কারাবন্দি। তার কারাবন্দির পর রিজভীকে অন্তত ২০টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। আগেও ৭০টির বেশি মামলার আসামি তালিকায় রয়েছেন রুহুল কবির রিজভীর নাম।

রিজভীর এই অতিমাত্রায় ব্রিফিংয়ের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ‘রিজভী কেন প্রতিদিন ব্রিফিং করেন, আমরাও জানি না। অনেকেই ফোন করে জানতে চান— এতে দলের কি লাভ হয়? জবাব দিতে পারি না।’

তিনি স্বীকার করেন, ‘কতিপয় নেতা আছেন, যারা সংবাদমাধ্যমে নিজের চেহারা আর নাম দেখতে চান। যেহেতু তারা দায়িত্বে নেই, এজন্য দপ্তরের রিজভীর মাধ্যমে কাজটি করে থাকেন। ব্যক্তি ফায়দা ছাড়া এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। দিনকে দিন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়ছেন।’

সূত্র-পরিবর্তন ডটকম