সাতক্ষীরার ‘মিনি পাকিস্তানে’ চলছে আ. লীগের পাহারা

যে আগরদাড়ি গ্রাম সারা সাতক্ষীরা জেলায় পরিচিতি পেয়েছিল ‘মিনি পাকিস্তান’ হিসেবে, সেই গ্রামে ঢোকার পথেই হকচকিত হতে হলো। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর। গ্রামের বাবুলিয়া বাজারের আগে কালের কণ্ঠ সাংবাদিকদের পথ আগলে দাঁড়ায় কয়েকজন যুবক। তাদের হাতে লাঠি ও জিআই পাইপ।

যুবকদের একজন বলেন, ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন? কোথায় যাবেন?’ সাংবাদিক পরিচয় শুনেই ওই যুবক বলেন, ‘তাইলেকোনো সমস্যা নাই, আপনারা যান, নিশ্চিন্তে ঘুরে দেখেন।’

পরিচয় জানতে চাওয়ার কারণ কী, হাতে লাঠিসোঁটাই বা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে যুবকরা জানান, তাঁরা এলাকার ছেলে। নাম রিয়াজুল ইসলাম, আসলাম হোসেন, লেলিন ও মিজান। তাঁরা বলেন, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ঠেকাতেই গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে আছে। কারণ তাদের ভয়—জামায়াতের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা একাধিক নাশকতার মামলায় আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়ালেও নির্বাচনের সুযোগে এলাকায় ফিরতে পারে, নাশকতাও চালাতে পারে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে খুলনা বিভাগের তৎকালীন ডিআইজি ও সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ সেই সদর উপজেলার আগরদাড়ি ইউনিয়নের মিনি পাকিস্তান খ্যাত আগরদাড়ি গ্রামে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন কয়েক ঘণ্টার জন্য। অতিরিক্ত ফোর্স পাঠিয়ে তাঁদের উদ্ধার করা হয়। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সব পাল্টে গেছে।

আগরদাড়ির পাশেই খলিলনগর গ্রামে আগরদাড়ি কামিল মাদরাসা। মাদরাসার পাশেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আসামি জামায়াত নেতা খালেক মণ্ডলের বাড়ি। তিনি ২০০৮ সালে সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যও ছিলেন। তিনি এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাগারে আটক আছেন। তাঁর বাড়ির সামনেই মাইকে বাজছিল গান ‘শেখ হাসিনার সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন’। সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল এক দল শিশু-কিশোর।

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কুশপুকুর এলাকার ভোটার আল আমিন বলেন, ‘এ এলাকায় জয় বাংলা স্লোগান দূরের কথা, আওয়ামী লীগের নাম মুখে নিতেও ভয় পেত দলটির নেতাকর্মীরা। সময়ের ব্যবধানে এখন সাবেক এমপির বাড়ির সামনে নৌকা মার্কার স্লোগান এবং দাপটে প্রচারণা চলছে। এটা সম্ভব হয়েছে জামায়াতের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি এলাকার সাধারণ মানুষের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের কারণে।’ এ সময় আরেক যুবক বলেন, ‘শুধু আগরদাড়ি গ্রাম নয়, জামায়াতের এমনই ভয়ংকর ঘাঁটি ছিল সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাড়ি ইউনিয়নের কাথন্ডা, কুশখালী, বৈকারী, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের গোবিন্দকাটি, শিবপুর ইউনিয়নের খানপুর, পায়রাডাঙ্গা, সাতক্ষীরা পৌরসভার রইচপুর, খড়িবিলা, আলিপুর ও বাকাল গ্রাম।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আগরদাড়ি ইউনিয়নের বাবুলিয়া বাজার, আবাদের হাট, কাশেমপুর, কুচপুকুর ও কামালকুড়া এলাকার মোড়ে মোড়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বসানো হয়েছে অলিখিত পাহারা। অপরিচিত কেউ এলাকায় ঢুকলেই সার্চলাইটের মতো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সতর্ক নজর। প্রথমেই দেখে নেওয়া হচ্ছে তার গতিবিধি। জামায়াতে ইসলামীর লোক কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হচ্ছে বারবার।

আগরদাড়ির কুচপুকুর এলাকার ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আব্দুল আলীম বলেন, ‘তাণ্ডবের হোতা আগরদাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আনারুল ইসলাম যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হওয়ার পর থেকে পালাতে শুরু করে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। এরপর পুলিশের একটানা অভিযানে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে তাদের সাম্রাজ্য।

এখন এখানে শুধু নৌকার জোয়ার। ধানের শীষেরও কোনো খাওয়া নেই।’ আগরদাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান মজনুর রহমান মালী বলেন, মানুষ উন্নয়ন দেখেই ভোট দেবে। তবে সাতক্ষীরা জেলা ভূমিহীন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলীনুর খান বাবুল বলেন, ইভিএমে যদি জালিয়াতি না হয় আর সব ভোটার যদি কেন্দ্রে আসতে পারে, তবে জামায়াতের নীরব ভোটাররা নৌকার প্রার্থীকে বিপদে ফেলে দিতে পারে।

দলীয় নেতাকর্মীরা জানায়, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। এবারও তিনি নৌকার প্রার্থী। এখানে বিএনপি থেকে ধানের শীষের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তিনজন। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির শুরা সদস্য আব্দুল খালেক ধানের শীষে নির্বাচন করছেন।

কিন্তু প্রতীক পাওয়ার পরপরই নাশকতার মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। আর ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির আব্দুল জব্বার। এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাতলুব হোসেন লিয়ন মহাজোটের প্রার্থী হতে না পেরে নিজেই লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। তবে নৌকার প্রতীকের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির লাঙলের প্রচার-প্রচারণা দেখা গেলেও ধানের শীষের নেই কোনো প্রচারণা।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি বলেন, ‘নৌকা প্রতীক জয়ী করতে জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা এক হয়ে কাজ করছেন। নেতারা পাড়ায় পাড়ায় সরকারের উন্নয়ন নিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। মানুষ আর সন্ত্রাস, নাশকতা ও জঙ্গিবাদ পছন্দ করে না।’

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনছুর আহম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন বলেন, এ আসনে নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এক হয়ে জামায়াতের ঘাঁটিতে নৌকার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

জেলা বিএনপির সভাপতি রহমতুল্লাহ পলাশ, সাধারণ সম্পাদক তারিকুল হাসানসহ জেলার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা মোবাইল ফোনে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নেই। জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত সব নেতাকর্মী ও সমর্থকের নামে শত শত মামলা। এসব মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে তারা এলাকায় থাকতে পারছে না। এর পরও ভোটাররা কেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে ধানের শীষ প্রতীকই জয়ী হবে বলে তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আজিজুর রহমান বলেন, ‘ভোটের মাঠে নেতাকর্মীরা প্রচার করবে কিভাবে? এলাকায় যেতেই পারছে না। ধানের শীষের প্রার্থী জামায়াত নেতা আব্দুল খালেককেও জেলে আটক রাখা হয়েছে।’

জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মো. আজাহার হোসেন বলেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এম এ জব্বার এমপি নির্বাচিত হন। এবারও দলটির নেতাকর্মীরা লাঙল প্রতীক বিজয়ী করতে বাধাহীনভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।–কালেরকন্ঠ