গায়ানা থেকে প্রতিনিধি : আইসিসির র্যাংকিংয়ে টেস্ট আর ওয়ানডের সেরা অলরাউন্ডার তিনি। টি-টোয়েন্টিতে তিন নম্বরে। তাই “আপনার কি গেইলকে বল করার ব্যাপারে ‘মেন্টাল ব্লকেজ’ আছে”—প্রশ্নে সাকিব আল হাসানের ইগোতে সামান্য হলেও চোট লাগার কথা। কিন্তু সেসব তিনি বুঝতে দিলে তো! শুধু সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় চোখের মণি বস্ফািরিত করেই আবার তিনি স্বাভাবিক, ‘ওটা টিম প্ল্যানের অংশ। অধিনায়ক যা বলবে, তা-ই তো করতে হবে।’
ক্রিস গেইলের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব করেছেন সাকিব নিজেও। গত বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ফাইনালে ঢাকা ডায়নামাইটসের অধিনায়ক তিনি ক্যারিবীয় ব্যাটিং দানবের ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি দেখেছেন সীমানাদড়ির ওপর দাঁড়িয়ে, নিজের কোটার এক ওভার বোলিংই করেননি! রবিবার গায়ানায় প্রথম ওয়ানডেতে ওভারের পর ওভার গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু সাকিব ফিল্ডিংয়ে সেই সীমানাদড়ির কাছে। তাঁকে বল হাতে নিতে দেখা গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের ২৬তম ওভারে, তার আগেই ফিরে গেছেন গেইল। এ দুটি ঘটনার যোগসূত্র তো রয়েছেই, যা শুধুই অধিনায়ক কিংবা দলীয় পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ নয়। সাকিব অবশ্য সেরকম দাবিও করেননি, ‘বাঁহাতি স্পিনার পেলে গেইল মারবেই। আর গেইল মারলে কী হয়, তা তো দেখেনই। তা ছাড়া আমাকে কেন, বিশ্বের কোনো বাঁহাতি স্পিনারকেই ও ছাড়ে না। হয়তো এ কারণে…।’
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক একটি প্রবণতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়। ডানহাতি ব্যাটসম্যান পেলেই বাঁহাতি স্পিনার দিয়ে আক্রমণে যাওয়া আর বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বেলায় উল্টোটা। গেইলের জন্য যেমন মেহেদী হাসান মিরাজ আর মোসাদ্দেক হোসেনের সঙ্গে প্রয়োজনে মাহমুদ উল্লাহকে ব্যবহারের ‘দুরভিসন্ধি’ও রয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজার।
তার মানে তো এই নয় যে বাংলাদেশের কোনো অফস্পিনার ডানহাতি ব্যাটসম্যানের উইকেট পায়নি, সাকিবের ক্যারিয়ারেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান রয়েছেন। তবু কেন চিন্তার এমন সীমাবদ্ধতা? ‘এটা শুধু আমরা না, এখন বিশ্ব ক্রিকেটে সব দলই করে। আর আমি যে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে বল করিই না, তা কিন্তু না। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেনের মতো ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে বোলিং করেছি। আইপিএলে সব দলেই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান আছে। আমি ওদেরও বোলিং করি। কিন্তু গেইল আলাদা ব্যাপার!’
তাতে ধরে নেওয়া যায় গেইল ক্রিজে থাকলে আজও বল হাতে পাবেন না সাকিব। আগের ম্যাচে ২২তম ওভারে আউট হয়েছিলেন ক্যারিবীয় ওপেনার। কিন্তু আজ যদি আরো দীর্ঘস্থায়ী হন, তাহলে? এক ম্যাচ হাতে রেখে সিরিজ জয়ের লক্ষ্যে নামা বাংলাদেশের জন্য এ এক বড় চ্যালেঞ্জই, দলের সফলতম বোলারকে অপেক্ষায় বসিয়ে রাখতে চাইবে কোন দল?
যদিও প্রথম ম্যাচে বিসদৃশ এ ঘটনাই দেখা গেছে। এ নিয়ে মাঠে মজার ঘটনাও ঘটেছে। একের পর এক বোলিং পরিবর্তন করছেন মাশরাফি, কিন্তু বাঁহাতি স্পিনার (সাকিব) আর আসছেন না দেখে শিমরন হেটমায়ারকে নাকি বলেন তিনি, ‘ওই দেখো, আরেকটা অফস্পিনারকে আনছে ওরা!’ সেই অফস্পিনারটি মোসাদ্দেক, গেইলকে বোতলবন্দি করে রাখার জন্য যিনি ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন দলের। তো, গেইল আরো বেশি সময় টিকে গেলে মাহমুদ উল্লাহকে দিয়ে বোলিং করানোর পরিকল্পনাও নাকি ছিল মাশরাফির। সেটির আর প্রয়োজন পড়েনি, রান আউট হয়ে ফিরে গেছেন গেইল।
একদা সৌরভ গাঙ্গুলির বিরুদ্ধে ভারতের সব বাঁহাতি স্পিনারের নীরব অভিযোগ ছিল। তিনি নাকি এ শ্রেণির বোলারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযুক্তই মনে করেন না! এর কারণ অবশ্য সৌরভ নিজে যে বাঁহাতি স্পিনারদের ওপর নিয়ম করে ঝড় বইয়ে দিতেন। ক্রিস গেইলের মনে এমন উন্নাসিকতা আছে কি না, কে জানে। তবে প্রতিপক্ষ দলের বাঁহাতি স্পিনারদের প্রতি তাঁর ন্যূনতম ‘শ্রদ্ধাবোধ’ নেই। সে তিনি সাকিব হলেই বা কি!
তবে বয়সের ভারে অনেকটাই মন্থর হয়ে পড়া গেইলের প্রতি পর্যাপ্ত শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে বাংলাদেশের। তিনি উইকেটে দীর্ঘস্থায়িত্ব পেলে যে এখনো বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারেন, সে ‘বিশ্বাস’ হারায়নি বাংলাদেশ দল। তাই টিম হোটেলের খোলা জায়গায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সোনালি সময়ের প্রতিনিধি জেফ্রি ডুজনের সঙ্গে বৈঠক দেখে ফিসফাস ওঠে বাংলাদেশ দলে, ‘কী আলাপ করছেন?’ গেইলও ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগের মতো দিলখোলা নন আর। বিপিএল সূত্রে পরিচিত বাংলাদেশি ক্রিকেটার দেখলে হাসছেন বটে, তবে সেই গদগদ ভাবটা নেই।
হাবে-ভাবে মনে হচ্ছে নিজের সুখ্যাতিতে ভাটার টান অনুভব করছেন গেইলও। নিজের দেশ জ্যামাইকায় সম্মাননা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বঘোষিত ‘ওয়ার্ল্ডবস’ আন্দোলিত করেন দূরের গায়ানার গ্যালারিকেও। তবে শুধু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান তুললে কি আর চেনা ছবিটা চোখে ভাসে দর্শকের। তাই ইনিংসের মাঝপথে গেইলের চেয়ে ঘরের ছেলে হেটমায়ারের জন্যই বেশি তালি পড়ে গায়ানার গ্যালারিতে।
লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে গেইলের আর সাকিবের অহমের চোট যেন সমান গভীর একটা জায়গায়। আগের মতো শুরু থেকেই আর চড়াও হওয়ার ঝুঁকি নেন না গেইল। আর গেইল ক্রিজে থাকলে ফিল্ডিংয়ে মন সঁপে দিয়ে থাকে।