প্রবাসী বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বাড়ছে

মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম (৩৩)। বাড়ি মেহেরপুরের গাংনীতে। ২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানে বেশ ভালো আয়ের পর দেশে ফিরে আসেন। এখন তিনি দেশে ইট ভাটার ব্যবসা করছেন। সৌদি আরব যাওয়ারও তার আর ইচ্ছে নেই। এই ব্যবসায়ই বেশ ভালো আছেন তিনি।

খায়রুল ইসলাম বলছিলেন, ‘প্রবাসে আয়ের টাকা দিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। এখন আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। সৌদি আরবে আর যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই, আরও কিছু ব্যবসায় বিনিয়োগ করার ইচ্ছা আছে। এক সময় আমার কিছুই ছিল না। সারাজীবন প্রবাসে থাকবো এই ইচ্ছা কোনো দিনেই ছিল না। প্রবাসে আয়ের টাকা দিয়ে দেশে কিছু একটা করবো এই ইচ্ছা প্রথম থেকেই ছিল।’

খায়রুল ইসলামের মতো বিপুলসংখ্যক জনশক্তি প্রবাসে আয়ের পর বিনিয়োগ করছেন দেশে। অবকাঠামোসহ নানা ধরনের ছোট ছোট অর্থনৈতিক ইউনিট গড়ে তুলছেন প্রবাসীরা। যাতে সরাসরি সৃষ্টি হচ্ছে মানুষের কর্মসংস্থান, বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক চিত্রও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত অর্থনৈতিক শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

বিবিএসের ওই প্রতিবেদন মতে, দেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে প্রবাসীদের বিনিয়োগ রয়েছে ৯০ হাজার ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানে। ২০০১-২০০২ অর্থবছরে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪ হাজার ৩৪০টি।

প্রতিবেদনের তথ্য, প্রবাসীদের বিনিয়োগের যে ৯০ হাজার ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ৫৫ হাজার ৮৯৩টি। এক লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৬ হাজার ৪৪৭টি, আর ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০ হাজার ৯৪২টি।

প্রবাসী বিনিয়োগে সর্বাধিক ২৮ হাজার ৯৪৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপরেই রয়েছে বরিশাল বিভাগের নাম। এই বিভাগে রয়েছে ২ হাজার ৯৭৯টি প্রতিষ্ঠান।

অর্থনৈতিক শুমারি প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন বলেন, ১০ বছর আগে কী ছিলো এখন কী হয়েছে তা ভাবা যায় না। পোল্ট্রি ফার্ম, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোকান ও বাড়ি ঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা কাজে বিনিয়োগ করছেন প্রবাসীরা। প্রবাসীদের টাকায় নির্মিত একটা বাড়িও বিনিয়োগের মধ্যে পড়ে। কারণ এটা জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) হিসাব করা হয়।

বিবিএসের ওই প্রতিবেদন বলছে, মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ফলেই বাড়ছে প্রবাসীদের হাতে গড়া অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৩২ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ কোটি ডলার বা ২১ শতাংশ বেশি। গত বছর এপ্রিলে রেমিট্যান্সের অংক ছিল ১০৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, এপ্রিলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বিগত অর্থবছরের দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) মোট আয়ও বেড়েছে। এসময় মোট এক হাজার ২০৮ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। গত বছর (২০১৭ সাল) ১০ মাসে এক হাজার ২৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।

বিবিএস সূত্র জানায়, প্রবাসী বাংলাদেশিরা পাকা ও সেমি পাকা ঘর নির্মাণ, ফ্ল্যাট ক্রয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ির পাশে সড়ক নির্মাণে ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইলেকট্রনিক্স পণ্য সেবায় তাদের ০ দশমিক ৯৩ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে, তাদের বিনিয়োগের ৮ শতাংশ যানবাহন ও ভূমি খাতে। এছাড়া পুকুর খনন করে মাছ চাষে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ, অর্থ শিল্প কারখানায় ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ, কম্পিউটার-সফটওয়্যার খাতে দশমিক ০৩ শতাংশ, বৃক্ষরোপণ, নার্সারি, পোল্ট্রি, গরুর ফার্ম ও কৃষি যন্ত্রপাতি কেনায় ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ রয়েছে প্রবাসীদের।

১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি শ্রমিক চাকরি নিয়ে গেছেন। সবচেয়ে বেশি গেছেন সৌদি আরবে, প্রায় ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৬ জন। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরাক, লেবানন ও জর্ডানেও বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ নিয়ে গেছেন। আফ্রিকার লিবিয়া, সুদান, মিশর ও মরিশাস, ইউরোপের যুক্তরাজ্যে ও ইতালি এবং এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ব্রুনাইয়েও রয়েছেন উল্লেখযোগ্য প্রবাসী।

সূত্র: বাংলানিউজ