পুতিনের বশে ট্রাম্প- যতদিন ইতিহাস ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনে রাখবে, ততদিন কুখ্যাত হয়ে থাকবে এই দিনটি। সোমবার হেলসিঙ্কিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বৈঠকটি ইতোমধ্যেই দুই দেশের জর্জরিত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে কলঙ্কজনক সময় বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা পৃথিবীর ওপরই গুরুত্বপূর্ণ ও অননুমেয় রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে সোমবারের এই বৈঠক।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা নিশ্চিত করার পরও পুতিন তা অস্বীকার করেন। পুতিনের বক্তব্যের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন শুধু বিদেশের মাটিতে কোনো প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে শোচনীয় কর্মকাণ্ড। এতে বুঝা গেল ট্রাম্প আমেরিকার চেয়ে তার নিজের স্বার্থকে বেশি গুরত্ব দেন।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- ‘ট্রাম্প কেন এতো সহজে পুতিনের বশ্যতা স্বীকার করলেন’ তা সামনের দিনগুলোতে হয়তো এতো দ্রুত পরিষ্কার হবে না। অন্তত ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে বাধা পড়ে আছেন তার প্রমাণ স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মুয়েলারের তদন্তে না পাওয়া গেলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সারা বিশ্বেই এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আগামী দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে, সে বিষয়ে কিছু পর্যালোচনা দেয়া হলো।
পাল্টা আক্রমণ করবেন ট্রাম্প
১৯৬১ সালে সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভের হাতে ভিয়েনায় নাকাল হয়েছিলেন কেনেডি। পরে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের জেমস রেস্টনের কাছে তিনি স্বীকার করেন, ওই বৈঠক ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে ঘটনা।
তবে সোমবার ফক্স নিউজের শন হানিটিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এমন কোনো উপলব্ধির কথা না জানালেও, অপদস্থ হওয়ার যে বর্ণনা কেনেডি দিয়েছিলেন তা ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের বেলাতেও খাটে।
বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে গেলে, ওই স্মমেলনে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তাকে দেখে দুর্বল মনে হয়েছে। রাশিয়ার নেতার পাষাণ মূর্তির তুলনায় তাকে চাটুকার, অপ্রস্তুত ও নিম্নশ্রেণীর মনে হয়। তর্জন-গর্জন করে দরকষাকষিতে অভিজ্ঞ হিসেবে ট্রাম্পের যে খ্যাতি রয়েছে তা থেকে যেন তিনি অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন।
বলিষ্ঠ আমেরিকান হিসেবে ট্রাম্পের যে ভাবমূর্তি ছিল তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এই স্মমেলন যে ট্রাম্পের জন্য একটা রাজনৈতিক বিপর্যয় ছিল তা পরিষ্কার। নিজের সম্পর্কে অতি সচেতন ট্রাম্প সমালোচকদের তির্যক মন্তব্যে জ্বলে উঠবেন এবং পাল্টা আক্রমণ করবেন।
হাউজ স্পিকার পল রায়ানের মতো উচ্চ পর্যায়ের রিপাবলিকান নেতা, যিনি সাধারণত ট্রাম্পের সমালোচনা করেন না, তিনিও ট্রাম্পের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন।
রিপাবলিকান পার্টির হাউজ স্পিকার পল রায়ান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো নৈতিক মিল নেই। রাশিয়া আমাদের বেশিরভাগ মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন।’
ট্রাম্পের সমর্থক নিউট গিংগ্রিচও একটি টুইটে বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুতিন সম্পর্কে ট্রাম্প হেলসিঙ্কিতে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা তাকে স্পষ্ট করতে হবে। এটা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এবং এটা অবশ্যই তাকে শুধরে নিতে হবে- এখনই।’
ট্রাম্প যে তালগোল পাকিয়েছেন তা ঠিক করতে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দেশে ফেরার সময় তিই কয়েকটি টুইট করেন। তিনি লেখেন, ‘আগের মতই আমি আজকেও বলেছি- আমার গোয়েন্দাদের ওপর আমার বিশাল আস্থা রয়েছে। তবে, আমি এটাও স্বীকার করেছি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে হলে কেবল অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। বিশ্বের দুই পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে আমাদের মানিয়ে চলতে হবে।’
খুব সম্ভব, ট্রাম্প আরও জোরেশোরে ফিরে আসবেন এবং আলচনার বিষয় পাল্টে ফেলবেন। কোণঠাসা হয়ে পড়লে তিনি পাল্টা আক্রমণ করেন। মঙ্গলবার থেকে টুইটারে কথার তুবড়ি ছোটানো শুরু করতে পারেন তিনি।
এখন কী করবে পশ্চিমা দেশগুলো?
মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ট্রাম্পের। কিন্তু, তেমন মানুষরা রাশিয়ার স্বৈরশাসকদের কাছে মাথা নত করে না। ইউরোপ সফরের শেষে ছিল ট্রাম্পের সোমবারের সম্মেলন। এই সফরে তিনি সেখানকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছেন। কার্যত পুতিনের হয়ে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র মত মিত্রদের অপমান করেছেন।
ট্রাম্প ইউরোপ ত্যাগ করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা যা আশঙ্কা করেছিল, হেলসিঙ্কির বিপর্যয়ে ঠিক তাই ঘটেছে এবং ওই দেশগুলোর ভবিষ্যৎ পদক্ষেপও এর ভিত্তিতে গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এখন আর হোয়াইট হাউজের ওপর নির্ভর করতে পারছি না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে আমাদের এটা অবশ্যই পুনর্গঠন করতে হবে।’
প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে ট্রাম্প তার মিত্র দেশগুলোর সমালোচনা করলেও, গত সপ্তাহের ন্যাটো সম্মেলনে আটলান্টিকের দুইধারের দেশগুলোর প্রতিরক্ষা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর মত বাহিনী উন্নত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব দেশের কোনো একটিকে আক্রমণ করা মানে সবগুলোকে আক্রমণ করা- এই নীতির ওপর তাদের জোট প্রতিষ্ঠিত হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীকী নেতৃত্ব একটা অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়। ইউরোপ একারণে ক্রমেই নার্ভাস হয়ে পড়ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ‘হোয়াইট হাউজ’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষণীয়। ইউরোপীয়রা পাগলাটে প্রেসিডেন্টের বদলে ক্ষমতার আরও অন্যান্য কেন্দ্রের মাধ্যমে কিভাবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে তা এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায়।
ইউরোপ ঘিরে ট্রাম্পের ঐক্যনাশা সফর সত্ত্বেও আটলান্টিকের দুই পাড়ের দেশগুলোর মধ্যে সামরিক, বাণিজ্যিক, গোয়েন্দা সংস্থা ও সুশীল সমাজের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক অটুট রয়েছে। ট্রাম্প-ঝড় পেরিয়ে যাওয়ার জন্য এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো শিক্ষক নিকোলাস ডুঙ্গান মনে করেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর ও যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত পরিস্থিতি উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
তিনি বলেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন, অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের মতো মিত্রদের উচিত দ্বৈত পন্থা গ্রহণ করা।
‘আপনাদের উচিত দুটি ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য স্বতন্ত্র কৌশল নেয়া উচিত, কারণ বুঝাই যাচ্ছে তিনি নিজের সাথে দায়িত্বের কোনো পার্থক্য করেন না। আরেকটি কৌশল গ্রহণ করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য’ যোগ করেন ডুঙ্গান।
পুতিন তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন
পুতিনের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯৮৯ সালে বার্লিনের দেয়াল ভেঙে পড়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেখা। ওই সময় তিনি পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে কর্মরত ছিলেন।
ওই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতায় কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধের বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৈরি ক্ষোভ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার উৎসর্গ করেন মস্কোর অপমানের শোধ নিতে।
সারা বিশ্ব এবং নিজের দেশের মানুষের সামনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে নিজেকে উন্নত হিসেবে উপস্থাপন করে পুতিন একটি চক্র সম্পূর্ণ করলেন।
ফক্স নিউজের বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল র্যাল্ফ পিটার মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে সোমবার বলেন, ট্রাম্প তার দেশ ও প্রেসিডেন্ট পদের জন্য একটা ‘কলঙ্ক’।
মার্কিন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমবারের বৈঠক থেকে পুতিন এটাই শিক্ষা নিবেন যে ট্রাম্প দুর্বল এবং যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও তার জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির সাবেক উপ-পরিচালক রিচার্ড লেজেট বলেন, ‘পুতিনের মুখোমুখি হওয়ার একটা সুযোগ হারিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। আমরা জানি, আপনি এটা করেছেন এবং এমনটা করা বন্ধ না করলে আমরা কী করব তা জোর দিয়ে পুতিনকে জানানোর সুযোগ হারিয়েছেন তিনি।’
এখন ভয় হচ্ছে- হেলসিঙ্কিতে ট্রাম্পের সমর্থন পেয়ে পুতিন আরও উৎসাহিত হতে পারেন। গত ২০১৬ সালের মতোই তিনি রাশিয়ার হ্যাকিং ও হস্তক্ষেপের উপায় উন্নত করে নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচন বা ২০২০ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারেন।
রিপাবলিকান দল, মন্ত্রিসভার সদস্য ও হোয়াইট হাউজের কর্তাদের করণীয়
হেলসিঙ্কিতে ট্রাম্প তালগোল পাকানোর পর এখন তার কর্মকর্তা ও সমর্থকদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ট্রাম্প বিদেশে আমেরিকার হয়ে মাথা উঁচু করে না দাঁড়িয়ে আমেরিকার শক্তি, মূল্যবোধ ও ঐতিহাসিক অর্জনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন একজন বিশ্বনেতার সাথে তাল মেলালে কী কিছু আসে যায়?
ট্রাম্পের বৈঠকে বিব্রত হয়েছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানরা যার মধ্যে জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক ড্যান কোটস। ট্রাম্প সংবাদ সম্মেলনে তার বিরোধিতা করেছেন।
হেলসিঙ্কি সম্মেলনের পর কোটস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ও আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে তাদের চলমান সার্বজনীন কর্মকাণ্ডের কথা আমরা স্পষ্ট করে জানিয়েছি।’
কিন্তু ট্রাম্পের আচরণের কারণে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা কিভাবে স্বপদে বহাল থাকবেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সোমবার হোয়াইট হাউজ ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করে কোনো বক্তব্য দিতে না পারায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভবত নতুন করে নিজেদের ভূমিকার মূল্যায়ন করবেন।
সোমবারের ঘটনাপ্রবাহের পর রিপাবলিকান দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন। তাদের প্রেসিডেন্টকে সামলানোর জন্য নতুন করে চাপ আসবে তাদের ওপর।