স্বপ্নের ফাইনালে ফ্রান্স

এ এক অনন্য গল্প, একদল বীর ফুটবল সৈনিকদের নিয়ে। এ গল্প, একদল নির্ভীক, সৎ ও সাহসী যোদ্ধাদের নিয়ে। যাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে। যাদের আছে নিজেদের প্রতি পরম আস্থা। এ কারণেই, সেমিফাইনালের মতো চরম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচেও প্রথম ৬২ মিনিট কোনো কার্ড দেখাতে হলো না উরুগুয়ের রেফারি আন্দ্রেস কুনহাকে। ৬৩তম মিনিটে তিনি প্রথম হলুদ কার্ড দেখান বেলজিয়াম অধিনায়ক ইডেন হ্যাজার্ডকে। ম্যাচের শুরুর দিকের এই সম্প্রীতি অবশ্য শেষদিকে ছিল না। দুই দলের ফুটবলাররাই জড়িয়ে পড়েন ভয়ঙ্কর যুদ্ধে। এই ফুটবল যুদ্ধে ১-০ গোলের জয় পেয়ে যায় ফরাসিরাই। ২০০৬ সালের পর ফের বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে এলো ১৯৯৮-এর শিরোপাজয়ী ফ্রান্স।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা ঘটছে, যেখানে সেমিফাইনালে নেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা অথবা জার্মানি। গত ২০টি আসরের সবকটিতেই এই ‘বিগ থ্রি’-এর কোনোটা ছিল। ‘বিগ থ্রি’র যুগ শেষ করে দিল নতুন নতুন ফুটবল পরাশক্তি। বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়ার মতো দলগুলো ফুটবলের নতুন বিজ্ঞাপন হয়ে উঠল রাশিয়া বিশ্বকাপে। আর গতকালের সেমিফাইনাল ম্যাচ হয়ে থাকল আধুনিক ফুটবলের একটি অপূর্ব নিদর্শন।

বেলজিয়ামের স্প্যানিশ কোচ দারুণ এক কৌশল এঁটেছিলেন। ফেল্লিনিকে বিশ্বকাপের বেশিরভাগ সময়ই তিনি খেলিয়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। তার দায়িত্ব ছিল, হ্যাজার্ড-ডি ব্রুইনদের বল সাপ্লাই দেওয়া।

সেই ফেল্লিনিকেই ফ্রান্সের বিপক্ষে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করেন মার্টিনেজ। অনেকটা ফল্স নম্বর নাইনের মতো! তাছাড়া সাধারণত লেফ্ট উইংয়ে খেলা নাসের চ্যাডলিকে ডান প্রান্তে খেলিয়েও ফরাসিদের বিভ্রান্তিতে ফেলতে চেয়েছিলেন বেলজিয়াম কোচ। ফ্রান্সের ফরমেশনটা বরাবরের মতোই ছিল। পল পগবা খেলছিলেন অনেকটা নিচ থেকে। কেবল গ্রিজম্যানই ঘন ঘন স্থান বদলে দিকভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিলেন বেলজিয়ামের ডিফেন্ডারদের। ডিফেন্সে দুটি দলই এত শক্তিশালী, কোনো পক্ষই যুতসই আক্রমণে যেতে পারছিল না।

ইডেন হ্যাজার্ড আর ডি ব্রুইনরা যেমন বার বারই উমতিতি-ভারানেদের বাধার মুখে পড়ছিল, ঠিক তেমনি এমবাপ্পে-গ্রিজম্যানদেরও রুখে দিচ্ছিলেন কম্পানি-ভারটঙ্ঘেনরা। ১৬তম মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে হ্যাজার্ডের সেকেন্ড বারে নেওয়া শটটাই ছিল প্রথম শক্তিশালী আক্রমণ। ফরাসিরা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল!

তবে গোলবারের বাইরে দিয়ে বল চলে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল তারা। এরপর বেশ কয়েকটি আক্রমণ রুখে দেন ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিস। কর্টয়েসকে ফাঁকি দিয়েও প্রথমার্ধে কোনো গোল করতে পারেনি ম্যাচের ৫১তম মিনিটে আঁতোয়ান গ্রিজম্যানের কর্নার কিক থেকে বল পেয়ে হেডারে দারুণ এক গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ফরাসি ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি। সঙ্গে সঙ্গেই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাকরনকে অভিনন্দন জানান ফিফা সভাপতি জিয়ানি ইনফ্যান্টিনো এবং বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ। এরপরই শুরু হয় ফরাসি সমর্থকদের সমস্বরে কোরাস। ‘আ-লে, আ-লে, আলে, আলে, ব্লু (গো, গো, গো, গো ব্লু)।’ চমৎকার এই কোরাস শুনতে শুনতে ফরাসিদের ফাইনাল খেলার ক্ষুধা বাড়তেই থাকে। ম্যাচের শেষদিকে অনেকটাই ডিফেন্সিভ হয়ে যায় দিদিয়ের দেশমের শিষ্যরা। কিন্তু একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার জন্য কিছুটা ডিফেন্সিভ হলেই বা ক্ষতি কী! বেলজিয়াম দারুণ ফুটবল খেলেছে। ওদের ড্রিবলিং, ওদের পাসিং, বল ধরে রাখার ক্ষমতার কাছে ম্লান ছিল ফ্রান্স। কিন্তু দিনশেষে জয়টা ছিনিয়ে নিয়েই মাঠ ছাড়ল ১৯৯৮-এর চ্যাম্পিয়নরা। থিয়েরি অঁরি ম্যাচের আগেই তার জাতীয় দলের অধিনায়ক দিদিয়ের দেশমকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন।

ম্যাচটা হেরে যাওয়ার পর আবেগকে লুকিয়ে রেখে তিনি প্রথম কর্তব্যটাই পালন করলেন। বেলজিয়ামের ফুটবলারদের সান্ত্বনা দিলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন ফরাসিদের দিকে। ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপজয়ী তারকা থিয়েরি অঁরি স্বদেশিদের পরম আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ফাইনালে উঠার জন্য অভিনন্দন জানালেন। দিদিয়ের দেশমকে ফাইনালের জন্য শুভকামনা জানালেন। আর ফরাসি তারকারা মাঠটা চক্কর দিয়ে পৌঁছে গেল সমর্থকদের দিকে। যারা ম্যাচজুড়ে দলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। বেলজিয়ামের বিদায়ে একটা সম্ভাব্য ইতিহাস আর গড়া হলো না। প্রথম ভিনদেশি কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিততে পারতেন মার্টিনেজ। তার বিদায়ে নিশ্চিত হয়ে গেল, আরও একবার স্বদেশি কোচেরাই বিশ্বকাপ জিতবে। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়া, তিন দলেরই রয়েছে স্বদেশি কোচ।