সন্তান
জামাল উদ্দিন জীবন
আফছার আলী ও আফরোজা বেগমের সুখের পরিবার।স্বপরিবারে তাদের বসবাস হেমায়েতপুরে আজগর আলী পরিবারের বড় সন্তান। মা বাবার আদর ভালোবাসা পাবার কথা বেশি তার।সত্যি বলতে সেই সবার কাছে অবহেলার পাত্র হয়েছে।অন্য ভাই বোনদের তুলনায় সব কিছু হতে লেখা পড়া ও সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত মানুষ।এমনি ভাবে অতিবাহিত হতে থাকে তার জীবন।অনেক কষ্ট করে সে বড় হয়েছে কারো কাছ হতে সহযোগীতাও পায়নি।অনেক কষ্টে দিন অতিবাহিত করেও অন্যের দ্বারে সাহায্য প্রার্থনা করেনি।ধীরে ধীরে পরিবারের অন্য সদস্যরা বড় হয়েছে আগের তুলনায় পরিবারের খরচও বেড়েছে বেশ।প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে বাবা মায়ের সাথে কথা কাটা কাটি হয়।আজগর তার নিজের সাধ্য মত চেষ্টা করে পরিবারকে সাহায্য করার। মা বাবা সবি জানে বুঝে তবুও তাকে সকলের কাছে অনেক কথা শুনতে হয় দিন রাত। রাগে দুঃখে আর ঘৃনায় এক সময় সে পরিবার হতে আলাদা হয়ে যায়। হেমায়েতপুরে তার এক মাত্র বন্ধু রাশেদের সাথে তার সম্পর্কটা থেকে যায়। ভাগ্যের পরিবর্তন করতে ঢাকায় আসে।দেখতে দেখতে দুটি বছর পেরিয়ে যায়।দিন দিন বয়স বাড়ছে তার।একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারির চাকরি নেয় আজগর।কিন্তু সেখানে কাজের তেমন স্বাধীনতা নেই।প্রতি নিয়োতো মালিক বিভিন্ন রকমের কথা শুনায়।মনে মনে ভাবে অন্য একটা কাজ যোগাড় করে আমাকে এই চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে।দোকানের পাশের একটি মেসে এ রাজনের সাথে আজগর থাকে।রাজন একটি গার্মেন্টেন্স এ কাজ করে।প্রাই দেখে তার বন্ধুর মন খারাপ।আজ আর কাজে যায়নি আজগর শরীরটা বেশ খারাপ করেছে। চলবেচলবেচদুপুরে রাজন বাসায় এসে দেখে বন্ধু আজগর শুয়ে আছে। রাজন জানতে চায় কি হয়েছে।আজগর সব খুলে বলে এবং তার কাছে পরামর্শ চায় কি করবে।রাজন বলে তুমি বেশি চিন্তা করোনা দেখি আমার অফিসে লোক নিলে তোমার কথা বলবো।তিন/চার দিন দোকানে যেতে পারেনি অসুস্হতার কারণে আজগর।আজ দোকানে গিয়ে দেখে নতুন লোক আছে একজন।মালিক হারুন সাহেব এখনও আসেনি।সে দোকানের কাজ করছিল এমন সময় হারুন সাহেব তাকে ডাকে।আজগর কাছে এসে জানতে চায়?কেন ডেকেছে।আমার দোকানে নতুন লোক নিয়েছি তোমার আর দরকার নেই বলে জানায় মালিক। আজগর বলে ঠিক আছে আপনি না চাইলে আমি আর কাজ করবোনা দেোকানে।আমার বেতনটা দিয়ে দেন।হারুন সাহেব বলে এক সপ্তাহ পর এসে নিয়ে যাস।যা এখন আমার চোখের সামনে হতে দুর হয়ে যা।স্বাভাবিক ভাবেই বাসায় ফিরে আসে সে।মনে মনে চিন্তা করে কি করবে এখন।বাসায় না গিয়ে কাজের সন্ধান করতে থাকে।পরিচিত সকলকেই বলে রাখে কাজের জন্য। অনেক দিন পর বন্ধু রাশেদের কথা মনে পড়ে।কত দিন দেখা হয় না তার সাথে। একবার কি তার সাথে দেখা করে আসব।আবার ভাবে তাওর সাথে দেখা করতে হলে আমাকে গ্রামে যেতে হবে।না না আর ফিরে যাবনা আমি।রুমে বসে বসে চিন্তা করছে।পাশের বাড়ির আমেনা বেশ কিছু দিন থেকেই তাকে কিছু বলতে আর বুঝাতে চায়।সে বুঝেও না বুঝার মত করে এড়িয়ে যায় সব সময়। আমেনা আজ দুপুরের দিকে দেখে আজগর রুমে বসে আছে।তাকে বসে থাকতে দেখে বলে কি ব্যপার কাজে যান নাই আজ।আজগর কথা শুনে বুঝতে পারে আমেনা কথা বলছে।না জাইনি কাজটা ছেড়ে দিছি।তুমি বাসায় কেন অফিসে যাওনি আজ।আমেনা না রোজ রোজ অফিস করতে আর ভাল লাগে না। শরীলটাও ঠিক নেই তাই আর যাইনি।আমেনা বলে আজতো ফ্রি আছেন আমাকে একটু বাহিরে বেড়াতে নিয়ে যাবেন।আজগর বলে ঠিক আছে বিকালে তৈরী থেকো।আমেনা অনেক খুশি হয় তার কথা শুনে।এত দিনে তার মনের আশা বাস্তবে রুপ নিতে চলেছে।প্রিয়জনের সাথে ঘুরতে যাবার আনন্দটাই আলাদা।বিকালে ঘুরতে বেড়িয়ে দুজন দুজনার পরিবারের সকল খবরা খবর নিল।ঢাকা আসার কারণটাও জানালো আজগর।আমেনা বলে ছোট বেলাতে মা মারা গেছে।সৎ মায়ের সংসারে ছিলো বছর পাঁচেক।তাকে নিয়ে এখন বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলে আর অশান্তি হয় তাই ঢাকায় আসে বেঁচে থাকার তাগিদে। আমেনা বলে সে যদি চায় তবে তার হাসপাতালে কাজের জন্য চেষ্টা করতে পারে।আজগর বলে দেখো যদি হয় তবে ভাল হবে।কথায় কথায় কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তারা বুঝতেও পারেনি।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে চলো বাড়ি ফেরা যাক হুম চলো।আজগর দুদিনের জন্য তার বন্ধু রাশেদের সাথে দেখা করতে গ্রামে আসে।নিজের বাড়ি হতে বেশ কিছুটা দুরে বন্ধুর সাথে দেখা করে আর কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিয়ে আবার ঢাকার পথে পা বাড়ায়।রাশেদ বলে আমি সময় মত তোমাকে সব খবর জানাবো তুমি চিন্তা করোনা।আজগর আর আমেনা একই হাসপাতালে চাকরি করছে।ছয় মাস পর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো।দিনে দিনে তার পরিবার বড় হতে লাগলো মোটা মুটি সুখেই কাটছে তাদের সংসার।আফছার ও আফরোজা বেগম এখন বৃদ্ধ হয়েছেন।মেঝো ছেলে ডাক্তার,সেঝো ছেলে উকিল, মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সাথে বিদেশ চলে গেছে।ছোট ছেলে গাজীপুরে স্ত্রী,সন্তান নিয়ে বাড়ি করে থাকে।কোন খবর নেয় না বাবা মায়ের।বয়সের ভারে এখন আর আগের মত কাজ করতে পারেনা শরীলেও বিভিন্ন অসুখ বাসা বেঁধেছে। আফরোজা বেগম অনেক চেষ্টা করেছেন স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে। জায়গা জমি যা ছিল বিক্রি করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারলেননা। অনেকের কাছে টাকা পয়সা ধার করেছেন তারাও এখন পাওনা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে তাকে।নিজের অবস্হাও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আফরোজা বেগমের।একা একা থাকে তাকে কেউ দেখতেও আসেনা এখন।একটা সময় বাড়ি ভরা মানুষ ছিলো এখন তিনি একলা পথের যাত্রী যেন অপেক্ষা করছেন ওপারে যাবার জন্য।রাশেদ অনেক দিন পর ঢাকায় বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে তাদের বাড়ির সব ঘটোনা খুলে বলে।আজগর ও আমেনার খুব কষ্ট লাগে সব কথা শুনে।একবার ভাবে বাড়িতে চলে আসবে আবার তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটোনা গুলো। বন্ধুকে বলে ঠিক আছে তুমি যাও দেখি আমি কি? করতে পারি।আমেনা দেখে আজগরের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে।স্বামীকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পায়না সে।তাদের ঘরে একটা ছেলে আরিফ নাম বয়স দুই বৎসর।আরিফ মাঝে মধ্যে বাড়ির অন্য মুরুব্বিদের কোলে যায় তাদের দাদা –দীদা বলে।এ ব্যাপারটাও তাকে বেশ কষ্ট দেয়।দুজনেই তাদের কষ্টের দিনগুলো মনে করে তাদের ভিতরটা যেন খাঁ খাঁ করে নিদারুন শূন্যতা আর হতাশায় ডুবে যায়। আরিফের হটাৎ করে বেশ শরীর খারপ করেছে।শুধু দাদু দাদু বলে ডাকে।জ্বর কোন ভাবেই কমছেনা।ডাক্তারা অনেক চেষ্ট করেও কিছু করতে পারছে না। কোন উপায় না দেখে আজগর তার বন্ধু রাশেদকে খবর পাঠালো তার মাকে নিয়ে ঢাকায় আসতে।খুব জরুরী কাল সকালেই চলে আসে।রাশেদ আর দেরি না করে আফরোজা বেগমকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়ে যায়| কোথায় যাবে জানতে চায় আফরোজা বেগম। রাশেদ তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে ছেলে ও স্ত্রীর কাছে।আফরোজা বেগম অনেক কথা জানতে চায় আমেনার কাছে।আমেনা বলে কি বলবো মা সে তার পরিবার হতে অবহেলিত ও বঞ্চিত হয়ে চলে এসেছে।তার মা-বাবা তাকে অনেক অবহেলা করেছে সেই কারণে তার নিজ গ্রামটাকেও ভুলে গেছে।তোমার স্বামীকে একবর ডাক দেখি আমি তার মুখটা দেখতে চাই।তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আজগর সব কথাই শুনছিল দরজার আড়াল হতে।আমেনা এসে আজগরকে বলছে আসেন মা আপনাকে দেখতে চায়।আজগর বলে তুমি যাও আমি আসছি।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আরিফ তার নতুন দীদাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে।সে আগের থেকে অনেকটা ভালো এখন। ডাক্তারাও অবাক হয়েছে আরিফকে ধীরে ধীরে সুস্হ হতে দেখে।আজগর আসলো তার মায়ের কাছে। আফরোজা বেগম দেখে ছেলেকে চিনতে পারে।বাপ তু্ই এখানে বলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেংগে পড়ে।আজগরও নিজেকে আর স্হির রাখতে পারে না।সেও সব মান অভিমান দুঃখ কষ্ট ভুলে মায়ের কাছে যায়।বাবা আমারে মাফ কেইরা দে আমি তোর প্রতি অনেক অন্যায় করছি বাপ।তার শাস্তি আল্লাহ আমারে দিছে। আজগর আর কোন কথা বলতে পারে না।মা এ কথা বলোনা আমাকে অপরাধী করবা আল্লার কাছে। ছেলে আর বউকে দিখিয়ে বলে এটা আমার বউ আর ছেলে।আফরোজা বেগম তার ভুল বুঝতে পারে সকলকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না করে।রাশেদ বলে বন্ধু সব ঠিক হলো এবার আমাকে বিদায় দাও।আরে তুমি কোথায় যাও? চলো আমাদের সাথে বাড়িতে। রাশেদ বন্ধুর বাসায় বেড়িয়ে দুদিন পর গ্রামে ফিরে আসে।মাস খানেক পরে রাশেদকে খুঁজতে কিছু লোক তার বাসায় আসে।রাশেদ নিজের কাজে বাহিরে যায়।দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে।বাড়িতে ফেরার পথে বন্ধুর বাড়ির দরজাটা খোলা দেখতে পেয়ে কৌতুহল বসত সেখানে যায়। দেখে অনেক লোক ঘরের মধ্যে বসে কথা বলছে।রাশেদ ঘরে প্রবেশ করে দেখে আজগরের পরিবারের বাকি সদস্যরা আছে।রাশেদ অবাক হয় কি এমন হলো যার কারণে সবাই আবার গ্রামে ফিরে এলো।তাদের ছেলে মেয়েরা নানা-নানীর জন্য বায়না করছে।ছোট ছোট সন্তানেদের আবদার কোন ভাবেই তারা পূরন করতে পারছে না।পিতা মাতা হয়ে সন্তানদের কোমল মনে কোন খারাপ ধারনা জন্ম দেওয়া তাদের কে ভুল শিক্ষা দেওয়া কোন পিতা-মাতার কাম্য নয়। নিতান্তই নিরুপায় এবং এক প্রকার সন্তানদের চাওয়ার কাছে হেরে গিয়ে তারা গ্রামে ফিরেছে। রাশেদ দুর হতে সবই দেখে আর বাড়িতে ফিরে য়ায়।সকালে আজগরের পরিবারের সদস্যরা এসে তার বাড়িতে হাজির হয়।রাশেদ নাস্তা করছে এমন সময় ছেলে রাতুল এসে বলে বাবা তোমাকে কিছু লোক ডাকছে। ছাবিহা ছালাম প্রদান করে জানতে চায় কেমন আছেন রাশেদ ভাই।রাশেদ বলে আলহামদুল্লিহ ভালো আছি।আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম নাতো।বলে ভাই অনেক কষ্টে আজ আপনাকে পেয়েছি। আপনি কেন অচেনা মনে করছেন আমাদের।রাশেব বলে জি বলুন আমি কি সাহায্য করতে পারি আপনাদের। ভাইয়া আমাদের মা-বাবা কোথায় আছে বলতে পারেন?রাশেদ বলে এতদিন পর তাদের কি প্রয়োজন পড়লো আপনাদের জানতে পারি আমি।তখন ছেলেরা এগিয়ে এসে বলে ভাই আমাদের বলেন তাদের খবর।রাশেদ আর কথা না বাড়িয়ে তাদেরকে আফছার আলীর কবরের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে এটা আপনাদের বাবার কবর।কি হয়েছিল তার।তখন রাশেদ সব ঘটোনা খুলে বলে।রাশেদের কথা শুনে তার কান্নায় ভেংগে পরে।তাদের কে শান্তানা দিয়ে বলে আপনার মা আছে ঢাকায়।গ্রামের লোকজন অনেক টাকা পয়সা পাবে তারা প্রাই জ্বালাতন করে।আমি তার কষ্ট দেখে তাকে আমার পরিচিত এক বন্ধুর কাছে রেখে এসেছি।আপনাদের মা খুব অসুস্হ হয়ে পড়েছে।তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলো নানা ভাই দাদু ভাই বলে কান্না করছে।সকলের সুবিধার জন্য সে আজগরের হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিলো।সকলে হাসপাতালে গিয়ে প্রথমে আজগর ও আমেনার সাথে দেখো করলো।বড় ভাইয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।তাদের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে।আজগর স্ত্রীকে বলে তুমি তাদের নিয়ে বাসায় যাও।আমি বাজার নিয়ে আসছি।সকলে এসে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে।আফরোজা বেগমকে দেখতে পেয়ে ছেলে মেয়োরা মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে কান্না কাটি করে।মাও তার সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে সন্তানদের বুকে টেনে নেয়।আজগর বাজার নিযে বাসায় ফিরে। দুপুরের খাবারের পরে সকলে বসে পারিবারিক একটা আলোচনায় বসে।সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তার বাবার নামে একটা হাসপাতাল করবে আর মায়ের নামে একটি এতিম খানা করবে।মা আজগরকে বলে বাবা সবতো শুনলা এখন তোমার কি?মত।আজগর বলে আমি আর কি বলবো তোমরা যা ভালো মনে কর সেটাই করো।কথা অনুজায়ি কাজ শুরু হলো।হাসপাতাল ও এতিম খানার দায়িত্ব দেওয়া হলো আজগরকে। তারা মাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসলো। সকলের পাওনা পরিশোধ করে দিয়ে মেয়ে জামাই তাদের স্হানে ফিরে গেলো।ছেলোরা বছর তিনেক পরে স্বপরিবারে ফিরে এলো মায়ের কাছে। আফরোজা বেগম আবার সকলকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস শুরু করলো।