মালয়েশিয়ার বহুল আলোচিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট পাকাতান হারাপান সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। নতুন এ সরকারের অধীনে প্রবাসীরা কতটা নিরাপদ এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। তবে দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় আছেন এমন প্রবাসীরা আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সাধারণ প্রবাসীদের একটি বড় অংশ মনে করে নাজিব রাজাকের নেতৃত্বাধীন বারিশান ন্যাশনাল জোটের নীতি অধিক প্রবাসীবান্ধব ছিল। নতুন সরকার সেই ধারাবাহিকতা রাখবে কিনা এ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে। বিশেষ করে বিগত সরকার অবৈধদের বৈধকরণে যে বিশাল রি-হেয়ারিং প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছিল তা এখনও শেষ হয়নি। ক্ষমতাসীনরা যদি এ প্রক্রিয়াকে স্থগিত বা বাতিল করে তাহলে কয়েক লাখ প্রবাসী ভিসা পাবে না। ভিসা বঞ্চিত এসব অবৈধ প্রবাসীদের ফিরতে হবে দেশে।
কয়েক মাস আগে রি-হেয়ারিং প্রক্রিয়ায় মাই ইজি’র মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন খুলনার সাজেদুল ইসলাম বাচ্চু। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চু’র এখন নিত্যদিনের ভাবনা বৈধকরণের প্রক্রিয়ায় তার ভিসা হবে কিনা তা নিয়ে। তার মতো অনেকেই আছেন যারা বৈধকরণ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে কয়েকটি ধাপ পার করেছেন, অপেক্ষায় আছেন ভিসা স্টিকারের জন্য। তাদের প্রত্যেকের মাঝে এ নিয়ে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে।
অনেকটা একই শঙ্কার মধ্যে আছেন সুংগাই বুলু এলাকার একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মী মেহেদি হাসান। তিনি বলছেন, মাই ইজি’র মাধ্যমে অনেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। মাই ইজিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের স্ত্রীর অংশীদারিত্ব রয়েছে। এখন গুঞ্জন শুনছি এই কোম্পানির মাধ্যমে ভিসা হবে না। এ নিয়ে বেশ চিন্তিত মেহেদি হাসান ও তার বন্ধুরা।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় ৬০ কি.মি. দূরের গ্রাম্য এলাকা কাপ্পারের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন আইয়ুব আলি। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ানরা যথেষ্ট ভালো এবং বাংলাদেশিদের পছন্দ করেন। তবে কিছু তামিল ভাষাভাষীর মানুষ আছে যারা সুযোগ পেলেই বাংলাদেশিদের পেছনে লাগে। সরকার পরিবর্তনের এই সুযোগে তারা সহজ সরল বাংলাদেশিদের হয়রানি করে কিনা এই ভয়ে আছি। কারণ আমাদের এই এলাকায় বেশিরভাগই তামিল।
কুয়ালালামপুরের হাংতুয়ায় কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সাইফুল ইসলাম বলেন, নিজের কোম্পানির ডিরেক্টর ভিসা নিয়ে ব্যবসা করছেন। এখন এই ভিসা যদি নবায়ন না করা যায় তাহলে ব্যবসার মূলধন ফেলে দেশে ফেরা ছাড়া উপায় থাকবে না।
যদিও এসব গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন প্রায় ১৪ বছর ধরে টাইম স্কয়ারে কাজ করা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাইফুল ইসলাম। তিনি মনে করেন, সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার পরিবর্তন হলেও প্রবাসী নীতির খুব একটা পরিবর্তন হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি অংশ মনে করে মাহাথির মোহাম্মদ প্রবাসীবান্ধব। তিনি সবসময় প্রবাসীদের দুঃখ বোঝেন। তবে তার বর্তমান রাজনৈতিক সহচর আনোয়ার ইব্রাহিম খুব একটা প্রবাসীবান্ধব নয়। বিশেষ করে আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে অ্যান্টি বাংলাদেশি মনোভাবের গুঞ্জন রয়েছে। বাংলাদেশিদের প্রতি তাই বৈষম্য হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা কোতারায়ার বাংলাদেশি বিজনেস কমিউনিটির সভাপতি রাশেদ বাদল মনে করেন, যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন প্রবাসী নীতি থেকে তারা খুব একটা সরে আসবে না। কারণ দেশটির অভ্যন্তরে প্রচুর মিল, কল-কারখানা রয়েছে যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। শ্রমিকের চাহিদা থাকায় এখনও প্রায় প্রতিদিনই বাইরে থেকে শ্রমিক আসছে মালয়েশিয়ায়। এ অবস্থায় প্রবাসী নীতি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। বরং বৈধকরণের রি-হেয়ারিং প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে ক্ষমতাসীন সরকার কিছু সংস্কার আনতে পারে বলে মন্তব্য করেন রাশেদ বাদল।
কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইআইইউএম-এ প্রবাসীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. মোঃ সায়েদ উদ্দিন। গবেষক ড. মোঃ সায়েদ উদ্দিনের মতে, সরকার পরিবর্তনে প্রবাসীদের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে সবসময়ই এ ধরনের ভীতি কাজ করে। তবে একটা কথা সবাইকে মনে রাখা উচিত প্রবাসীরা যেমন তাদের ভাগ্য উন্নয়নে মালয়েশিয়ায় এসেছেন ঠিক একইভাবে মালয়েশিয়ার প্রয়োজনে বাইরে থেকে এসব অভিবাসীকে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আনা হয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তবে বিগত সরকারের করা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য ইএমজিএস সেবার প্রক্রিয়াটি এ সরকার পরিবর্তন করলে বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. সায়েদ।