হৃদরোগ ও ক্যানসার থেকে মুক্তি দেবে যেসব চা

শীতের সকালে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা মনে এনে দেয় প্রশান্তি। সারা দিনের কর্ম উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিতে এই এক কাপ চায়ের জুড়ি মেলা ভার। কেউ দুধ চা খেতে ভালোবাসেন তো কেউ আবার লাল চা। দুধ চা না কি লাল চা, কোনটি বেশি উপকারী। পুষ্টিবিদদের মতে, লাল চা কঠিন রোগ হৃদরোগ ও ক্যানসার থেকে মুক্তি দিবে।

লাল চা, রং চা বা কালো চা এই ৩ নামেই পরিচিত। ইংরেজিতে বলা হয় ব্ল্যাক টি। দিনের শুরুটা যদি লাল চা দিয়ে শুরু তার চেয়ে ভালো অভ্যাস নাকি আর কিছুই হতে পারে না। অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ এই পানীয় শরীরের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এই চায়ে ফ্ল্যাভোনয়েডস, ফাইটোকেমিক্যাল, অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকে, যা শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সক্ষম।

বিজ্ঞানীরা গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন, কম মাত্রায় ব্ল্যাক টি সেবন করলে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। এই গবেষণাটি মূলত যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের একটি শাখা, ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।

গবেষকরা দেখেছেন যে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। আবার অতিরিক্ত পরিমাণে চা পান করলে কার্ডিও ভাস্কুলার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার সাথে ইস্কেমিক হার্টের সমস্যা এবং স্ট্রোকও হতে পারে।

অ্যানালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই নিয়মিত চা পান করেন। তবে যারা মূলত ব্ল্যাক টি সেবন করেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

সকালে খালি পেটে লাল চা খেলে পেটে সামান্য অস্বস্তি হতে পারে। তবে ভয়ের কারণ নেই। বরং খালি পেটে এই চা খেলে খাদ্যনালীতে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূর হয়।

হৃদরোগে যারা ভুগছেন তাদের জন্যও ব্ল্যাক টি হতে পারে কার্যকরী এক পানীয়। এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও কমায় এই চা। সমীক্ষার তথ্য অনুসারে, নিয়মিত লাল চা খেলে কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। দৈনিক লাল চা খেলে হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। গাঁটের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এই চায়ে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান। এমনকি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রং চা। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত এই চা খাদ্যতালিকায় রাখুন। এতে ডায়াবেটিস থাকবে নিয়ন্ত্রণে। জেনে নিন যেভাবে চা পান করলে দূরে থাকে হৃদরোগ ও ক্যানসার।

দারুচিনি চা

দারুচিনি, গোলমরিচ, লেবুর রস ও মধু দিয়ে বানাতে পারেন ভেষজ চা। এক চামচ দারুচিনির গুঁড়া, আধ চামচ গোলমরিচ গুঁড়া, এক চামচ লেবুর রস ও এক চামচ মধুর মধ্যে এক কাপ ফুটন্ত পানি দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে ছেঁকে নিন। দারুচিনির কুমারিন, গোলমরিচের পিপারিন প্রদাহের প্রবণতা কমাবে, বাড়াবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।

গ্রিন টি

মানদ দেহের জন্যে গ্রিন টি খুবই উপকারী। এক কাপ গ্রিন টি ২৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন সরবারহ করে মানদ দেহে। ক্যানসার প্রতিরোধক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় গ্রিন টি। এছাড়াও মস্তিষ্ক গঠনে সহায়তা করে গ্রিন টি। মানব দেহের ওজন কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

হারবাল চা

প্রকৃতি থেকে আহরণ করে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় হারবাল চা। আদা, পুদিনা পাতা, তুলসী পাতা, লেবু ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এই চা। হারবাল চা শরীরের জন্য অনেক উপকারী। ঠান্ডার জন্য এই চা বেশ ভালো কাজ করে। শরীরের জীবাণু নষ্ট করে, পেটে প্রদাহ কমায়।

আদা ও পুদিনা চা

তাজা পুদিনা কেবল খাবারের স্বাদই বাড়ায় না বরং হজমেও সহায়তা করে ও পাকস্থলির সমস্যা দূর করে। অন্যদিকে আদা রক্ত পরিষ্কার করে শরীর সুস্থ রাখে এবং ঠাণ্ডার প্রভাব কমায়। একটা কাপ ফুটন্ত পানিতে ৬-৭টি পুদিনার পাতা ও এক টেবিল-চামচ আদা কুচি দিয়ে ফুটিয়ে নিন। আদা টুকরা করে দেওয়ার চেয়ে কুচি করে দেওয়া ভালো, এতে সম্পূর্ণ নির্যাস বের হয়। চার পাঁচ মিনিট ভালো মতো ফুটিয়ে, গরম গরম পরিবেশন করুন।

অশ্বগন্ধা চা

রোজ সকালে বা বিকেলে এক কাপ অশ্বগন্ধার চা খেতে পারেন। এক কাপ ফুটন্ত জলে এক চা চামচ অশ্বগন্ধা মূলের গুঁড়া দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখুন মিনিট ১০-১৫। ছেঁকে লেবুর রস ও মধু দিয়ে খান। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি প্রদাহের প্রবণতা কমবে। সেই দূরে থাকবে হৃদ্‌রোগেও।

তুলসী চা

এক বাটি জলে এক মুঠো তুলসী পাতা ফুটতে দিন। টগবগ করে ফুটলে আঁচ কমিয়ে ১০ মিনিট ফোটান। এর পর এতে মেশান এক চামচ মধু আর দু’চামচ লেবুর রস। রোজ না হলেও সপ্তাহে তিন দিন খেতে পারেন। উপকার পাবেন।

লেবু ও গোলমরিচের চা

লেবু ও গোলমরিচের এই ঝাঁজালো চা কেবল শরীরকে ‘ডেটক্স’ করে না পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কালো গোল মরিচ নানান অসুখের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং গলার খুশখুশেভাব কমায়। প্রথমে এক কাপ পানি ফুটিয়ে নিন। এতে একটা লেবুর সম্পূর্ণ রস ও ১/৪ চা-চামচ কালো গোল মরিচের গুঁড়া মেশান। উপকারিতা বাড়াতে এতে এক চিমটি হলুদ মেশাতে পারেন। তিন চার মিনিট অপেক্ষা করে তা একটা কাপে ঢেলে নিন। মিষ্টিভাব আনতে এতে এক চামচ মধু যোগ করতে পারেন।

ক্যানসার বিরোধী চা যেভাবে বানাবেন

উপাদান: ১-২ কাপ পানি, আধ চা চামচ কালো চা পাতা, ১ চা চামচ সবুজ চা পাতা, ৪-৫ চা চামচ দুধ, আধ চা চামচ গ্রেট করা হলুদ, ৪-৫ তুলসী পাতা, ১/৪ চা চামচ দারুচিনি গুঁড়া, ১/৪ চা চামচ গোলমরিচ, আধ চা চামচ গ্রেট করা আদা, কয়েকটি রোজমেরি স্প্রিগ, এক চিমটি জাফরান এবং ১/৪ চা চামচ মৌরি।

কীভাবে তৈরি করতে হবে: এই অ্যান্টি-ক্যানসার চা তৈরি করতে, একটি প্যান মাঝারি আঁচে রেখে এবং ১-২ কাপ পানিতে কালো চা পাতা দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে। চা তৈরি হয়ে গেলে তাতে দুধ দিয়ে ২-৩ বার ফুটিয়ে নিতে হবে। এরপর তাতে গ্রিন টি পাতা ও সব মশলা দিতে হবে। মশলাগুলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফুটতে দিয়ে আঁচ বন্ধ করে দিতে হবে। চা বেশি ফোটালে চলবে না এবং হয়ে গেলে ঠান্ডা হতে দিতে হবে। যখন এই চা পান করা হবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চা গরম করে নিতে হবে। যখন চায়ে মশলা দেওয়া হচ্ছে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য গরম করা উচিত যা পানীয়ের সুগন্ধ এবং পুষ্টিকে ধরে রাখতে পারে।

ক্যানসার বিরোধী মশলা ও ভেষজ

আমাদের দেশে কিছু ভেষজ এবং মশলা রয়েছে যা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি হল হলুদ, জাফরান, রোজমেরি, ক্যারাওয়ে বীজ, আদা, রসুন, ডিল পাতা, জিরে, ধনে, লবঙ্গ, দারচিনি, সবুজ এলাচ, তুলসী ইত্যাদি। এই সমস্ত ভেষজ এবং মশলা ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করার এবং কিছু মশলা রান্নায় ও বিভিন্ন পানীয় তৈরিতেও ব্যবহার করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।

কাগজের কাপে চা পানে সাবধান

এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সারা দিনে অন্তত তিন কাপ চা খেয়েই থাকেন। আর প্রতি বারই যদি কাগজের তৈরি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে শরীরে প্রবেশ করে প্রায় পঁচাত্তর হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই ধরনের প্লাস্টিকে থাকে আয়ন, প্যালাডিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর সব পদার্থ। এ ছাড়াও মাইক্রোপ্লাস্টিকে রয়েছে বিসফেনল জাতীয় টক্সিক পদার্থ। তা ক্যানসারের অন্যতম কারণ। এই উপাদান মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণ ব্যাহত করে। অন্য দিকে পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যাও কমিয়ে দিতে পারে এই পদার্থ। ‘পলিইথিলিন’ জাতীয় এই ধরনের বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করলে রক্তের কোষগুলো ছোট ছোট অংশে ভেঙে গিয়ে প্লাজ়মা কোষের হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে পারে। তা থেকেই মারণরোগের আশঙ্কা তৈরি হয়।