মানব সভ্যতার ইতিহাসে খেজুর সুমিষ্ট প্রাচীনতম ফল হিসেবে বেশ পরিচিত। সংস্কৃত খর্জুর থেকে বাংলা খেজুর। যার বৈজ্ঞানিক নাম ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা। তালজাতীয় শাখাবিহীন খেজুর গাছ প্রধানত মরু এলাকায় ভালো জন্মে। পূর্ব ও উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোতে খেজুরের চাষ প্রচলন বেশি। অনেকের মতে ইরাক অথবা মিসর খেজুর ফলের আদি স্থান। প্রাচীনকাল থেকে খেজুর ফলের বাগান সৃষ্টি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্য ও ফলের উৎস হিসেবে খেজুর মানুষের জীবন ধারণের অন্যতম অবলম্বন ছিল।
আরব দেশগুলোর মরুভূমি এলাকায় যেখানে অন্য কোনো গাছপালা জন্মানো সহজ হয় না সেখানে খেজুর বাগান সৃষ্টি করে মরুদ্যান সৃষ্টি করা হতো। খেজুর যেসব দেশে বেশি চাষ হয় তার মধ্যে মিসর, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, সুদান, ওমান, লিবিয়া ও তিউনেশিয়া অন্যতম। চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও আমেরিকার কিছু অংশে সফলভাবে খেজুর চাষ করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে, এর মধ্যে সৌদি আরবে চারশো’র বেশি জাতের খেজুর উৎপাদন হয়। জনপ্রিয় জাতের মধ্যে আজওয়া, বেরহি, সামরান, জাহেদি, মরিয়ম, আনবারাহ, আসমাউলহাসনা, ইয়াবনি অন্যতম।
খেজুর অত্যন্ত সুস্বাদু ও রুচিশীল একটি ফল যা ফ্রুকটোজ ও গ্লাইসেমিক সমৃদ্ধ। খেজুরে রয়েছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। খেজুর রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়। খেজুর ফলকে চিনির বিকল্প হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এতে রয়েছে উপকারী তেল, ক্যালসিয়াম, সালফার, আয়রন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, কপার এবং আরও নানাবিধ খনিজ। রয়েছে উপকারী ভিটামিনও।
খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে বলা হয়- খেজুরে ক্যালোরি ২৭৭ গ্রাম, ১.৮১ গ্রাম প্রোটিন, মোট চর্বি ০.১৫ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৭৫ মিলিগ্রাম, ফাইবার ৬.৭ গ্রাম, ৩% ভিটামিন এ রয়েছে। এছাড়াও ভিটামিন বি রয়েছে ৬০.২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.৩ মিলিগ্রাম, তামা ০.৩৬ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৫৪ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৬৯৬ মিলিগ্রাম।
নানান খনিজ সমৃদ্ধ এই খেজুর বিশেষ করে পুরুষ দেহে নানান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে মুক্তি পেতে উপকারী। এর মধ্যে রয়েছে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, আলঝাইমার এবং হৃদরোগ। খেজুরগুলির শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার উন্নতির জন্য ভালো বলে বিবেচিত হয়। চলুন প্রতিদিন খেজুর খেলে যেসব রোগ দূরে থাকে জেনে নিই-
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক আঁশে পূর্ণ খেজুর ক্যানসার প্রতিরোধ করে। গবেষণা বলছে, নিয়মিত খেজুর খাওয়ার ফলে পেটের ক্যানসার প্রতিরোধ হয়। যারা নিয়মিত খেজুর খান তাদের ক্যানসার ঝুঁকি অনেক কম থাকে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি গবেষণায় জানা গেছে, অ্যাবডোমিনাল ক্যানসার রোধে খেজুর কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং অনেক সময় ওষুধের থেকে ভালো কাজ করে খেজুর।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
খেজুরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ডায়াবেটিসের চিকিত্সায় সহায়তা করে। এই ফলটি ইনসুলিন সিক্রেটে অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবারের উপস্থিতি একজন ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রা স্থির রাখে।
এনার্জির ঘাটতি দূর করে
খেজুরে থাকা প্রাকৃতিক সুগার রক্তে মেশার পর এমন মাত্রায় শক্তি জোগায় যা শরীর একেবারে চনমনে হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে মানসিক ক্লান্তি দূর করতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটায়
খেজুর খাওয়ার পাশাপাশি যদি নিয়মিত এই ফলটির পাতা খাওয়া যায়, তাহলে শরীরের এমন কিছু উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যে দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটে চোখে পরার মতো! সেই সঙ্গে নাইট ব্লাইন্ডনেসসহ অন্যান্য চোখের রোগের প্রকোপ কমতেও সময় লাগে না।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে
দুধ ও খেজুর- উভয়েই রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনের মাত্রা। এই দুটি জিনিস একসঙ্গে মিশলে আয়রনের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তে হিমোগ্লোবিন ও প্রোটিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, দুধের মধ্যে দুটি করে খেজুর দিয়ে ফোটানো হলে, সেই উপাদেয় খাবারটি সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর বলে মানা হয়। খালি পেটে একটি নির্দিষ্টি সময়ে এই উপকারী পানীয় খেতে পারেন। মাত্র ১০ দিনে রক্তাল্পতার সমস্যা উধাও হবে।
অ্যালার্জির প্রকোপ কমায়
খেজুরে সালফার কম্পাউন্ড অ্যালার্জির মতো রোগ থেকে দূরে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। যারা সারা বছরই এই রোগে ভুগে থাকেন, তাদের রোজের ডায়েটে এই ফলটি অবশ্যই রাখবেন।
ত্বকের বার্ধক্য প্রতিরোধ করে
প্রতিদিন খেজুর খেলে ত্বকে স্থিতিস্থাপকতা, আর্দ্রতা এবং চকমক নিয়ে আসে। এতে উপস্থিত ভিটামিন সি এবং ডি ত্বক শিথিল হওয়া রোধ করতে কার্যকরি ভূমিকা নেয়। শুধু এটিই নয়, খেজুরগুলিতে উপস্থিত অ্যান্টি-এজিং বৈশিষ্ট্যগুলি শরীরে মেলানিন সংগ্রহ করতে দেয় না। এটি আপনার ত্বককে দীর্ঘ সময়ের জন্য যুবক রাখে। পুরুষ ত্বকের যত্নে খেজুর ভীষণ ভাবে কার্যকরী। পুরুষরা সাধারণত ত্বকের জন্য কিছুই করেনা। সেক্ষেত্রে নিয়মিত খেজুর খেলে ত্বক ভেতর থেকে ভালো থাকবে।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সক্ষম
খেজুরে থাকা পটাশিয়াম ও সোডিয়াম দেহে উচ্চ রক্তচাপ কমায়। ও বাজে কোলেস্টেরল দূর করে ও শরীরে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম এবং খুব অল্প পরিমাণে সোডিয়াম। প্রতিদিন খেজুর খাওয়ার অভ্যাস দেহের খারাপ কলেস্টোরল কমায় এবং ভালো কলেস্টোরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
হার্টের সমস্যা দূর করে
বেশিরভাগ পুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায় অত্যাধিক কলেস্টেরলের কারণে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস পানিতে খেজুর ভিজিয়ে রাখুন। এবার সকালে উঠে সেই পানি পান করলে হার্টের সমস্যা কমবে। খেজুর হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। রক্তপ্রবাহে গতি সঞ্চার করে। শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের সমতা রক্ষা করে। খেজুরে আছে এমন সব পুষ্টিগুণ, যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে।
বন্ধ্যাত্ব দূর করে
খেজুরে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার অনেকগুলো রোগ নিরাময় করতে পারে। এটি খেলে ডায়াবেটিস, স্থূলত্ব এবং হৃদরোগ নিরাময় হয়। একই সাথে এটি পেটের ক্যানসার এবং আলসারের মতো অবস্থার ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। আফ্রিকায় দেখা গেছে পুরুষ বন্ধ্যাত্বের জন্য সেখানকার লোকেরা দীর্ঘ দিন ধরে খেজুর । তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজনে। শোনা যায় খেজুর ফুলের পরাগরেণু বন্ধ্যাত্ব দূর করে, শুক্রাণু বৃদ্ধি করে। খেজুর ও এর ফুলে থাকা পরাগরেণু ডিএনএ’র গুণগত মান উন্নত করে ওষুকোষের শক্তি বাড়ায়। পুরুষদের কাজের চাপে অনেক সময় শরীর দুর্বল লাগে সেক্ষেত্রে কয়েকটি খেজুর খেয়ে নিলেই ফিরে পাবে আগের এনার্জি।
বর্তমানে সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুর বাংলাদেশেই চাষ হচ্ছে। মরুর খেজুর চাষে সফলতার মুখ দেখছেন হাজারো তরুণ। বাংলাদেশে আপনি নিজেও খেজুর চাষ করে লাভবান হতে পারেন। খেজুর গাছ অনুর্বর এমনকি অধিক লবণাক্ত অঞ্চলে হয়ে থাকে। লাগানোর পর ৪-৫ বছর পর থেকে খেজুর দেয়া শুরু হলে এক নাগাড়ে ১৫০ বছর অর্থাৎ বাঁচার আগ পর্যন্ত খেজুর দিয়ে থাকে। খেজুর খুবই পুষ্টিমান হওয়ার কারণে ১ কেজি খেজুর দেহকে ৩ হাজার ৪৭০ ক্যালরি শক্তি যোগান দেয়। খেজুর গাছ থেকে যেমন রস পাওয়া যায় তেমনি জ্বালানি হিসেবে পাওয়া যায় গাছের কাঠ। খেজুর গাছ লবণাক্ত এলাকা, নদী ভাঙন, কৃষি কাজের উপযোগী আবহাওয়া তৈরিতে সাহায্য করে।