সাধারণত বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়লে দেশের বাজারে দামি এ ধাতুটির দাম বাড়ানো হয়। একইভাবে বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশের বাজারেও কমানো হয়। তবে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম তেমন না বাড়লেও দেশের বাজারে বহু মূল্যবান এ ধাতবপণ্যটির দাম বেড়েছে হু হু করে। স্থানীয় বাজারে ডলারের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধিকেই এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) ১০ দিনের মধ্যে চারদফা স্বর্ণের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিবারই দাম বাড়ার কারণ দেখানো হয়েছে স্থানীয় বাজারে তেজাবী স্বর্ণের (পাকা স্বর্ণ) মূল্যবৃদ্ধিকে। এর আগে দেশের বাজারে এভাবে কখনো স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়নি।
বাজুস সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডলারের অস্বাভাবিক দাম এবং সংকটের কারণেই দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম তেমন একটা না বাড়লেও ডলারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ডলারের এই দাম বাড়াকেই স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
বাজুস সূত্র বলছে, গত দুদিন বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কিছুটা বেড়েছে। এর সঙ্গে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আরও বেড়েছে। তাই কদিনের মধ্যে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার খোলা বাজারে এক ডলার রেকর্ড ১১৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এর আগে কখনো স্থানীয় বাজারে এতো দামে ডলার বিক্রি হয়নি। অন্যদিকে শেষ দুই কার্যদিবসে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২০ ডলারের ওপরে বেড়ে গেছে।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৯২ ডলার। এ হিসাবে এক গ্রাম স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় ৬৩ ডলার (এক আউন্সে ২৮ দশমিক ৩৫ গ্রাম)। এতে এক ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম দাঁড়ায় ৭৩৭ ডলার। প্রতি ডলার ১১৩ টাকা হিসাবে এক ভরি স্বর্ণের দাম আসে ৮৩ হাজার ৩১২ টাকা। এর সঙ্গে শুল্কসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে এক ভরি স্বর্ণের দাম ৮৫ টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের।
সর্বশেষ গত রোববার (৭ আগস্ট) দেশের বাজারে সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৯৮৩ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ হাজার ৩৩১ টাকা করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এতো দামে স্বর্ণ বিক্রি হয়নি।
পাশাপাশি ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৮৬৭ টাকা বাড়িয়ে ৮০ হাজার ৪৮২ টাকা করা হয়েছে। ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৫৭৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৬৮ হাজার ৯৯৩ টাকা। একইসঙ্গে সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম ভরিতে ১ হাজার ২৮৩ টাকা বাড়িয়ে ৫৬ হাজার ৯৭৯ টাকা করা হয়।
এর আগে গত ৪ আগস্ট ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৩৪৮ টাকা, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৪৯ টাকা বাড়িয়ে ৭৮ হাজার ৬১৫ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৯৩৩ টাকা বাড়িয়ে ৬৭ হাজার ৪১৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৫২৫ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ হাজার ৬৯৬ টাকা করা হয়।
এরও আগে গত ২৯ জুলাই ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭৪১ টাকা বাড়িয়ে ৮১ হাজার ২৯৮ টাকা, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৫৬৬ টাকা বাড়িয়ে ৭৭ হাজার ৫৬৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৯২৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৬ হাজার ৪৮৫ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম ভরিতে ২ হাজার ৪৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ হাজার ১৭১ টাকা করা হয়।
এর দুদিন আগে ২৭ জুলাই সবচেয়ে ভাল মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৩৪১ টাকা বাড়িয়ে করা ৭৮ হাজার ৫৫৭ টাকা, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ২৮৪ টাকা বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা এবং ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৩৪১ টাকা বাড়িয়ে ৬৪ হাজার ৫৬০ টাকা করা হয়। তবে সেসময় অপরিবর্তিত রাখা হয় সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম।
অর্থাৎ গত ২৭ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ১০-১১ দিনের ব্যবধানে দেশের বাজারে চার দফায় বেড়েছে স্বর্ণের দাম। এসময়ে ভালো মানের স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে ৭ হাজার ১১৫ টাকা। বিশ্ববাজারে এক আউন্স স্বর্ণের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকার নিচে থাকলেও ভালো মানের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮৪ হাজার টাকা। অথচ বিশ্ববাজারে যখন এক আউন্স স্বর্ণের দাম দুই হাজার টাকার ওপরে ছিলো তখন দেশের বাজারে এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৮০ হাজার টাকার নিচে।
বিশ্ববাজারে তেমন দাম না বাড়লেও দেশের বাজারে হু হু করে স্বর্ণের দাম বাড়ানো কতটা যুক্তিসঙ্গত, এমন প্রশ্নে বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া জাগো নিউজকে বলেন, এখন দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার মূল কারণ ডলারের দাম বৃদ্ধি। ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এখন ১১২-১১৩ টাকার নিচে এক ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের এ দাম ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে দেশে স্বর্ণের যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ঠিকই আছে।
এ ব্যবসায়ী বলেন, স্বর্ণের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো কারসাজি বা সিন্ডিকেট নেই। স্বাভাবিক নিয়মেই স্বর্ণের দাম বাড়ছে। দাম না বাড়ালে স্বর্ণ পাচার হয়ে যেতে পারে। তখন স্বর্ণের বাজারে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এমনিতেই এখন স্থানীয় বাজারে পাকা স্বর্ণ কম পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি স্বর্ণালংকার এক্সচেঞ্জ (পরিবর্তন) এবং পারচেজের (ক্রেতার কাছ থেকে কেনা) ক্ষেত্রে নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে বাজুস।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, স্বর্ণালংকার এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং পারভেজের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ বাদ যাবে। একইসঙ্গে স্বর্ণালংকার বিক্রির সময় প্রতি গ্রামে ৩০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
এতদিন স্বর্ণালংকার এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং পারভেজের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ বাদ দেওয়া হতো। এ হিসাবে এখন থেকে স্বর্ণালংকার এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ এবং পারভেজের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ বেশি অর্থ পাবেন ক্রেতারা।
স্বর্ণালংকার কেনার পর তা ফেরত দিলে এখন থেকে ক্রেতারা ৮৫ শতাংশ অর্থ ফেরত পাবেন। আর স্বর্ণালংকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পাবেন ৯২ শতাংশ অর্থ। এর আগে স্বর্ণালংকার ফেরত দিয়ে ৮০ শতাংশ আর পরিবর্তন করে ৯০ শতাংশ অর্থ পেতেন ক্রেতারা। সে হিসাবে এখন থেকে ফেরতে ৫ শতাংশ এবং পরিবর্তনে ২ শতাংশ অর্থ বেশি পাবেন তারা।