‘আমাদের সময় শেষ। আমরা চাই না, আমাদের মৃত্যু নিয়ে কোনো আলোচনা হোক।’— মঙ্গলবার (২১ জুন) সকালে কলকাতার বাঁশদ্রোণী থানায় এমন একটি ই-মেইল আসে। ই-মেইল পেয়ে লোকেশন ট্র্যাক করে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে সেই ঠিকানা চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর দেখা যায়, ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। পরে সেটি ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিছানায় পাশাপাশি দু’টি মরদেহ দেখতে পায় পুলিশ! তাদের নাম হৃষীকেশ পাল ও রিয়া সরকার। এদিকে এ ঘটনায় তৈরি হয়েছে একাধিক রহস্য।
জানা গেছে, পুলিশকে পাঠানো ই-মেইলে ওই দম্পতি লিখেছিলেন, তাদের মৃত্যু নিয়ে কোনো আলোচনা তারা চান না। তাই পুলিশও বেশিকিছু বলতে চায়নি। এমনকি, কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো, তাও জানায়নি পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, তারা আত্মহত্যা করেছেন।
২০১৯ সালে হৃষীকেশ পাল ও রিয়া সরকারের সম্পর্কের শুরু। হৃষীকেশ আগে ভারতের একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন। কিন্তু চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন তিনি। হাতে ও চোখে গুরুতর চোট লাগে। এতে চাকরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। চিকিৎসায় খরচ হয় অনেক টাকা। এরপরই ধরা পড়ে ব্লাড ক্যানসার।
রিয়া একটি পার্লারে কাজ করতেন। পরে হৃষীকেশের সঙ্গে ব্রহ্মপুরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। রেজিস্ট্রি করে বিয়েও সারেন তারা।
এরই মধ্যে লকডাউনে শুরু হয় প্রবল আর্থিক অনটন। ক্যানসারের চিকিৎসা চালাতে নানা জায়গা থেকে হৃষীকেশ ও রিয়া টাকা ধার করেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। সব মিলিয়ে তারা প্রায় ২৫ লাখ টাকা দেনা হয়ে যান। তাহলে সে কারণেই কী আত্মহত্যা? এই উত্তর দেয়নি পুলিশ।
পুলিশকে পাঠানো ই-মেইলে একটি উইল রেখে যাওয়ার কথাও লেখা হয়েছে। জানানো হয়েছে, তাপস দাস নামে এক ব্যক্তি এলে তার হাতেই যেন মরদেহ দু’টি দেওয়া হয়। রিয়ার পরিবার যেন মরদেহ না পায়।
ঘটনার পরে বাঁশদ্রোণী থানায় এসে তাপস বললেন, ‘একটি গাড়ি সার্ভিসিং সেন্টারে কাজ করা অবস্থায় হৃষীকেশের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন থেকেই ক্যানসারের কথা জানতাম। হৃষীকেশ বলেছিল, আমাদের মৃত্যুর পরে সৎকারের দায়িত্ব নিও। রিয়ার পরিবার যেভাবে অপমান করেছে, ওদের যেন দেহ না দেওয়া হয়।’
এদিকে পুলিশ দাবি করছে, ক্যানসারে আক্রান্ত হৃষীকেশের সঙ্গে বিয়ে মানতে পারেনি রিয়ার পরিবার। তাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রিয়া। গত দু’বছরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কিন্তু মৃত্যুর আগে সবাইকে একটি ভয়েস নোট পাঠিয়ে তাকে ও হৃষীকেশকে কীভাবে অপদস্থ করা হয়েছে, তা বলে গেছেন।
খবর পেয়ে থানায় হাজির রিয়ার মা মৌসুমী সরকার। তিনি কিছু না বললেও রিয়ার খালা লিপিকা সিংহ বলেন, ‘ছেলেটা বলেছিল, বিয়ে করবে না। এমনিই একসঙ্গে থাকবে। তাই আমরা আপত্তি করি। বিয়ে না করার কারণ জানতে চাইলে রিয়া বলেছিল, হৃষীকেশ ক্যানসারে ভুগছে। ২০২০-এর জানুয়ারিতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় রিয়া। আর যোগাযোগ রাখেনি।’
এ বিষয়ে ভারতের ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘সবকিছু জানার পরও দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একসঙ্গে থাকতে চাইলে, তাতে বাধা দেওয়া সামাজিক অশিক্ষা। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। ক্যানসার রোগীকে দূরে না ঠেলে, তার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এই ব্যাধির সঙ্গে লড়েও বিয়ে করার বা এমনিই একসঙ্গে থাকার অনেক উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শেষে লড়াই ছেড়ে আত্মহত্যাটা মানা যায় না।’