ঢাকায় লিভ টুগেদার গ্রুপ, সদস্য হাজার ছাড়িয়েছে

লিভ টুগেদার। দু’টি মন এক হলেই যার শুরু। তবে গোপনে চলে কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে লিভ টুগেদার চলে এলেও বর্তমান সময়ে তাদের একটি গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এক হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে ওই গ্রুপে। সবাই একই মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার। এই গ্রুপে সদস্য যোগ করার ক্ষেত্রে যাচাই করে নেয়া হয়। গ্রুপের সদস্যদের বেশিরভাগই ঢাকার ধানমণ্ডি, গুলশান, নিকেতন, বনানী, বারিধারায় থাকেন। এসব এলাকায় বাসা ভাড়া সহজেই পাওয়া যায়। বাড়ির মালিক বা কেয়ার টেকার বেশি ঝক্কি-ঝামেলা করেন না। এর বাইরে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায়ও অনেকে আছেন।

তপু। প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম। মা-বাবা দু’জনই শিক্ষকতা করেন। ছোটবেলা থেকেই সামাজিক নিয়মনীতির বাইরে তার চলাফেরা। তপু বলেন, যেভাবে চললে নিজের কাছে ভালো লাগবে সেটাকেই প্রাধান্য দিই বেশি। লিভ টুগেদার করি অনেক দিন। এটা আমার কাছে একটা স্বাভাবিক বিষয়। যার সঙ্গে থাকি সেও এটাতে অভ্যস্ত। আমাদের মধ্যে বন্ধনটা চমৎকার। দু’জন-দু’জনের খেয়াল রাখি। আমরা ভালো বন্ধু, ভালো প্রেমিক। সুখ দুঃখগুলো নিজেদের মতোই ভাগাভাগি করে নিই। তার মানে এই নয় যে, আমাদের লাইফ স্টাইল খুব বেপরোয়া। ৫ বছর ধরে লিভ টুগেদার করছেন তপু। তার সঙ্গী তনয়া। তপু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর তনয়া একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরি করছেন।

এ প্রতিবেদককে তপু বলেন, তখন আমরা দু’জনেই গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। সময়টা ২০১৩ সাল। সবেমাত্র ফেসবুক ও অনলাইন ব্যবহার শুরু করেছি। ফেসবুক এতোটা ভালো ব্যবহার না করলেও ব্লগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতাম। আমার লেখা পড়তো তনয়া। লেখালেখির মধ্যে দিয়ে তনয়ার সঙ্গে পরিচয়। তারপর নিয়মিত কথা হতো। দু’জন-দু’জনকে বুঝতে শুরু করি। মনের মিল থাকায় সম্পর্ক গভীর হয়। আমি ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সময় গড়াতে থাকায় আমরা আরও আপন হয়ে যাই। তনয়া একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন দু’জন আলাদা থাকতাম। তবে আমি যে বাসায় ছিলাম ওখানে প্রায়ই তনয়া আসা-যাওয়া করতো। ওই বাসায় বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া নিম্নআয়ের ছিলেন। তারা আমাদের বিষয়গুলো জানতেন কিন্তু কোনো ঝামেলা করতেন না। এক সময় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাসা বদল করি।

তনয়া বলেন, আমরা লিভ টুগেদারের পক্ষে ছিলাম। তাই দেরি না করে নতুন বাসা নিয়েছি। বাসা পেতে বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই পেয়ে যাই। একসঙ্গে আছি। মতের খুব একটা অমিল হয় না। একজন আরেকজনের পাশে থেকেছি। অসুস্থ হলে সেবা করা, রান্না করা, খাবার খাওয়া একসঙ্গে। দু’জন চাকরি করি। যা বেতন পাই সেটা খরচ করি। কখনো কার কত খরচ হলো হিসাব করিনি। তিনি বলেন, আসলে লিভ টুগেদার মানে যে ভিন্ন কিছু এমনটা নয়। লিভ টুগেদারে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমনটি পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাভাবিক। আমরা এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আশা করছি আজীবন এভাবেই থাকবো।

তপু বলেন, আমরা মনের মিলকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কোনটাতে সুখ- সেটাকে খুঁজছি। বিয়ে ছাড়াই এতো বছর ধরে একসঙ্গে থাকছি- তাই বলে কি আমরা অসুখী? কম দায়িত্ববান? আমাদের এই সম্পর্কের কথা আমার পরিবারের সবাই জানে। ঢাকায় এলে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সঙ্গেই থাকে। তনয়ার মা-বাবা না জানলেও তার বোন ও ভাইয়েরা বিষয়টি জানে। তবুও আমাদের দু’জনের পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আছে। দু’জনের পরিবার থেকেই বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। বিয়ের সিদ্ধান্ত এখনো নেইনি। নিতে পারবো কি-না সেটাও জানি না। যদি কখনো মনমানসিকতা বদলায় তাহলে হয়তো!

লিভ টুগেদার করেন তিথি। তিনি জানিয়েছেন, আমাদের প্রায় এক হাজার সদস্যদের একটি গ্রুপ আছে। সবাই একই মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার। এই গ্রুপে সদস্য যোগ করার ক্ষেত্রে আগে যাচাই করে নেয়া হয়। এখানে যারা আছে তাদের প্রায় সবার বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের ভেতর।

একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ঢাকার অফিসে চাকরি করেন নিথিতা। তিনি বলেন, অহরহ মানুষ তার প্রয়োজনে লিভ টুগেদার করছে। আমি অন্তত শতাধিক জুটিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। কারণ যেকোনো সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাই মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে আইনি জটিলতা ও টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবেও নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা দায়িত্ব থাকে। পারিবারিক-সামাজিক নানা বিষয় মেনে চলতে হয়।

সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ শুধুমাত্র তাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিভ টুগেদার করেন। এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। আবার কেউ কেউ বিয়ের আগে নিজেদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার জন্য করেন।
লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক ও আইনি বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ যারা লিভ টুগেদার করেন তাদের মধ্যে সব সময় ধরা পড়ার একটা ভয় কাজ করে। বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি থানা পুলিশের ভয় কাজ করে। বাসা ভাড়া পেতে বেগ পেতে হয়। বাসা পেলেও চড়া দামে ভাড়া দিতে হয়। ভাড়া নিলেও ভাড়াটিয়ার তথ্য পুলিশের কাছে জমা নিয়েও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। সঠিক তথ্য পুলিশকে দিতে অনেকে গড়িমসি করেন। বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। অনেকে আবার ভুয়া বিয়ের কাবিননামা তৈরি করে রাখেন। এ ছাড়া বাড়ির মালিক অভিভাবকের মোবাইল নম্বর চাইলে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের নম্বর দিয়ে বুঝ দিতে হয়।

পুরাণ ঢাকার এক তরুণ ও চাঁদপুরের এক তরুণী লেখাপড়া করতেন ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সূত্রেই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। ওই তরুণী থাকতেন একটি মহিলা হোস্টেলে। আর তরুণ তার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসতেন। কিছুদিন পর ওই তরুণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর পুরাণ ঢাকার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসবেন পরে। উদ্দেশ্য ছিল প্রেমিকার সঙ্গে একসঙ্গে থাকার। পরে তারা দু’জন ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটি সাবলেট বাসা নেন। ওই বাসায় শুরু করেন লিভ টুগেদার। আড়াই মাসের মাথায় তাদের বাসায় ডিশ সংযোগ দিতে আসেন এলাকার এক যুবক। ওই যুবকের মনে সন্দেহ জাগে তারা বিবাহিত কিনা! পাড়ার অন্যান্য যুবকের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে ওই তরুণ ও তরুণীকে রাস্তায় আটকে দেন ডিশ সংযোগ দেয়া ওই যুবক। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের আইফোন ও নগদ টাকা-পয়সা নিয়ে যান। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি ওই যুবক। বিষয়টি জানিয়ে দেন বাড়ির মালিককে। ডাক পড়ে ওই তরুণ-তরুণীর। কিন্তু তারা তাদের বিবাহিত সম্পর্কের কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলাতে পারেননি। পরে বাড়ির মালিকসহ পাড়াপ্রতিবেশীরা তরুণ-তরুণীকে স্থানীয় একটি কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেন। বিয়ের পরে তারা চার মাস সংসারও করেন। এ সময়ে ওই তরুণী ছিলেন আট সপ্তাহের গর্ভবতী। এরই মধ্যে তরুণী তার স্বামীর অস্বাভাবিক কিছু আচরণ লক্ষ্য করেন। তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অমিল ছিল। তাই ওই তরুণী স্বামীকে ডিভোর্স দেন।

আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও একটি মিডিয়া হাউজের কর্মী বলেন, সহকর্মী এক বন্ধুকে নিয়ে আমি পান্থপথ এলাকার একটি মেসে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম থেকেই আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমার যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার লিভ টুগেদারের ইচ্ছা ছিল। আমিও সিদ্ধান্ত নেই একসঙ্গে থাকবো। এক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয় বাসা ভাড়া নিয়ে। পান্থপথ, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান, গ্রিনরোড এলাকার অন্তত শতাধিক বাসা দেখে সুবিধামতো বাসা পাইনি। অনেক সময় বাসার মালিকের নানা প্রশ্ন শুনে চলে আসি। আবার অনেক বাসায় লিভ টুগেদার করাটাকে ঝুঁকি মনে হয়। যেসব বাসায় থাকার মতো অবস্থা ছিল সেখানে আবার ভাড়া বেশি চাওয়া হয়। আমরা দু’জনেই শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। পাশাপাশি ছোট চাকরি করি। একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই কোনোরকম দরকষাকষি না করেই ভাড়া নিই। কারণ, মনে ভয় ছিল বেশি দরদাম করলে হয়তো আর বাসা পাবো না।

সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক অনেকেরই আছে। তবে সেটা কেউ প্রকাশ করে না। ভারতের এক গবেষণায় বলা হয়েছে- প্রতি ১০ জনের ৮ জনেরই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশেও এরকম অনেক আছে। কিন্তু অনেকেই একসঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকে না। সময়-সুযোগ করে ভালোলাগার মানুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, লিভ টুগেদার করাটা অনেকের শখ। এটা রুচিগত ব্যাপার। বাংলাদেশের আইনে আছে কোনো নারী-পুরুষ যদি একত্রে থাকতে চায় তবে তাকে ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিয়ে করতে হবে। বিবাহিত ব্যক্তি যদি কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে লিভ টুগেদার করে তবে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধানও রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দুনিয়ার সব দেশেই কমবেশি এমন ঘটনা আছে। তবে একেক দেশের ধরন ও চর্চা একেক রকম। কারণ, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ প্রতিটি দেশে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। অনেকেই পরিবার গঠন করে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতে চায় না। এর মূল কারণ হলো- পরিবার মানে দায়িত্ব, আত্মত্যাগ, শেয়ার করা। এখানে একে অন্যের দায়িত্ব নিতে হয়। পছন্দ না হলেও অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। সেক্রিফাইস করতে হয়। একটা সময় মানুষ পতিতালয় বা সেক্সহাউজে গিয়ে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো। কিন্তু এখন এই বিষয়গুলোকে আরও আধুনিক ও সহজ করে লিভ টুগেদার পন্থা বলা হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ তার পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে শারীরিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি একাকিত্ব সময়টাও ভালোভাবে কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে বেশি উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা কমে গেছে। সবাই যে লিভ টুগেদার করছে- এমনটাও না। বিয়ে না করে থাকা বা লিভ টুগেদার কোনোটাকেই আমরা ইতিবাচক ভাবি না। সুত্র: মানবজমিন