ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন নারীর নামে হয়, জানুন রহস্য!

অতি প্রবল ঘূর্ণিঘঝড় ‘ইয়াস’ এরই মধ্যে ভারতে আঘাত হেনেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশে এ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানবে না। তবে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হতে পারে। সাগর এবং মহাসাগর থেকে ঘূর্ণিঝড় ও তুফানের সৃষ্টি হয়। এর থাবা যেখানেই পড়ে; সেখানেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। গত বছর আঘাত হানে ‘আম্ফান’ নামক ঘূর্ণিঝড়, তার তাণ্ডব শেষ হতে না হতেই আসে ‘নিসর্গ’।

প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ের নাম ভিন্ন হয়ে থাকে। এবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম ইয়াস। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণও বেশ আকর্ষণীয়। তবে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেন কে বা কারা? কীভাবে হয় নামকরণ? আর নাম রাখার পেছনের কারণ কী? কিংবা নারীর নামেই কেন ঘূর্ণিঝড় হয়? চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাদি-

প্রথমেই জেনে নিন নামকরণ শুরু হয়েছিল কীভাবে? ১৯৫৩ সাল থেকে, মায়ামির জাতীয় হ্যারিকেন সেন্টারের উদ্যোগে আটলান্টিক অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। এরপরে জাতিসংঘের একটি ইউনিট ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের বৈঠক ডাকে এবং ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করে।

ওয়ার্ল্ড মেটিরিওলজিকাল ওয়েদার অর্গানাইজেশন এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন ২০০০ সালে এর সদস্য দেশগুলোর পরামর্শ নিয়ে ঘূর্ণিঝড় ঝড়ের জন্য নাম প্রস্তুত করার কাজ শুরু করে- ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ওমান, পাকিস্তানের মতো আরও ১২ টি দেশের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কা, সুদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এই প্যানেলের অংশ।

নারীর নামে কেন ঘূর্ণিঝড়? ১৯০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নাম মেয়েদের নামের উপর ভিত্তি করে করা হতো। ক্যাটরিনা, নার্গিস, স্যান্ডি, রেশমি, রিটা, বিজলি, অগ্নি, নিশা, গিরি, হেলেন, চপলা, অক্ষি, লুবান, তিতলি, নিলুফার- এসব ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই!

অনেকেই আক্ষেপ করেই বলেন, শুধু মেয়েদের নামেই কেন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়? এ নিয়ে মজার সব যুক্তিও আছে। আবহাওয়াবিদরা মনে করতেন, মেয়েদের নাম সহজ হয়ে থাকে, যা মনে রাখাও সহজ। তাই হয়তো তাদের নামেই ঝড়ের নামকরণ হত। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় মার্কিন সেনা ও আবহাওয়াবিদরা নারী নামে ঝড়ের নামকরণ করার নিয়ম চালু করেন।

বছরের প্রথম যে ঘূর্ণিঝড় হত, তার নাম দিতেন ‘এ’ দিয়ে। বছরের দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হত ‘বি’ দিয়ে। এভাবে প্রতিবছর ইংরেজি বর্ণ দিয়ে পর্যায়ক্রমে নাম রাখতেন তারা। অবশেষে দেখা যায়, বিগত সবগুলো ঝড়ের নামই মেয়েদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে থাকে, নারীর নামেই কেন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়?

এরই জের ধরে ১৯ শতকের শেষের দিকে দক্ষিণ গোলার্ধের আবহাওয়াবিদরা ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া শুরু করে পুরুষের নামে। অস্ট্রেলিয়ানরা তখন অপছন্দের রাজনৈতিক নেতার নামে নামকরণ করতেন ঘূর্ণিঝড়ের। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, যে মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তার অববাহিকায় থাকা দেশগুলো নামকরণ করে।

পৃথিবীতে মোট ১১টি সংস্থা ঝড়ের নামকরণ করে থাকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভারত এখন পর্যন্ত ৮টি ঝড়ের নামকরণ করেছে। এর মধ্যে মাত্র একটি হলো মেয়েদের নাম- বিজলি। অন্যদিকে পাকিস্তানের ৮টি ঝড়ের নামকরণের মধ্যে ৭টিই মেয়েদের। তিতলি, নার্গিস, লায়লা ইত্যাদি। আর বাংলাদেশে ৭টির মধ্যে ৩টি মেয়েদের- চমলা, হেলেন ও নিশা।

কীভাবে নামকরণ করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের? প্রথম দিকে ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোর নামকরণ করা হতো না। কারণ তারা আশঙ্কা করেছিল যে সংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল এই অঞ্চলগুলোতে কোনো বিরোধ দেখা দিতে পারে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ ২০০০ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এবং এসক্যাপ এর অধীনস্থ আটটি দেশ- ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, এবং থাইল্যান্ড মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, যে এই অঞ্চলের সাইক্লোনের নামকরণ করবে তারা।

এর দায়িত্ব আরএসএমসি’কে দেওয়া হয়। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ প্রতিটি সদস্য দেশ তাদের নামের তালিকা পাঠানোর পর তা চূড়ান্ত করে একটি ডাব্লিউএমও/এসক্যাপ প্যানেল। যার পোশাকি নাম প্যানেল অন ট্রপিক্যাল সাইক্লোনস বা পিটিসি।

২০১৮ সালে ডাব্লিউএমও/এসক্যাপ দলে প্রবেশ করে আরও ৫টি দেশ- ইরান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ৬টি আঞ্চলিক আবহাওয়া কেন্দ্রই পৃথিবীর যেকোনো মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাইক্লোনের নামকরণ করে। যার মধ্যেই পড়ে আইএমডি এবং ৫টি ট্রপিক্যাল সাইক্লোন সতর্কতা কেন্দ্র।

কোন পদ্ধতিতে নামকরণ করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের? প্রথমে ৮ দেশ থেকে মোট ৬৪টি নাম অনুমোদিত করত। এখন ১৩টি দেশ মিলে, প্রতিটি দেশ থেকে ১৩টি করে নাম দেওয়া হয়। অর্থাৎ এখন ১৬৯টি নামের মধ্য থেকে বাছাই করা হয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম। এই দেশগুলোকে বর্ণানুক্রমিকভাবে স্থাপন করে, তাদের সামনে প্রস্তাবিত ১৩টি নাম রাখা হয়।

এরপরে যখনই ঘূর্ণিঝড় এই ১৩টি দেশের যেকোনো স্থানে আসবে; তখন বর্ণানুক্রমিকভাবে যেই দেশের ক্রম আসবে তার সামনে থেকে ঝড়ের জন্য একটি নাম বেছে নেওয়া হয়। ‘আম্ফান’ পুরোনো লিস্টের একটি শেষ নাম, যেটা থাইল্যান্ড দিয়েছিল। এরপর ছিল বাংলাদেশের পালা, সেই অনুসারে ‘নিসর্গ’’ নামটি বাংলাদেশের দেওয়া।

ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করার প্রয়োজনীয়তা কী? ঝড়ের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত নাম সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝতে কষ্টকর হবে। এ ছাড়াও, মিডিয়ার পক্ষে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত তথ্য দিতেও সমস্যা হতে পারে। তাই একটি ছোটো নাম রাখা হয়; যাতে মানুষ ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত তথ্য এবং সতর্কতাগুলো সহজেই সবাই বুঝতে পারে।

স্টর্ম এবং সাইক্লোনের মধ্যে পার্থক্য যখন হাওয়া ৬৩ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে প্রবাহিত হয়; তখন তাকে ট্রপিকাল স্টর্ম বলা হয়। যখন এর গতি প্রতি ঘণ্টা ১১৯ কিলোমিটারেরও বেশি হয়; তখন তাকে ট্রপিকাল সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় বলা হয়।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের নামকরণ রহস্য: ইয়াসকে ‘অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড়’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের একটি নাম আছে। যা জন্মের কয়েক বছর আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মানুষের নামের মতো তারাও এর প্রকৃতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। ঘূর্ণিঝড়ের ভিত্তিতে দেশগুলো ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়। ‘ইয়াস’ নামটি ওমান থেকে প্রাপ্ত। এই শব্দের উৎপত্তি ফারসি ভাষার এবং এর অর্থ ইংরেজি ভাষায় জেসমিন অর্থ হলো বেলি ফুল।

নামকরণের মানদণ্ড- ১. নামটি লিঙ্গ, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হতে হবে। ২. আপত্তিজনক বা কারও অনুভূতিতে আঘাত হানবে না। ৩. সংক্ষিপ্ত ও উচ্চারণ সহজ হওয়া আবশ্যক। ৪. সর্বোচ্চ ৮ বর্ণের হতে হবে।