ঘরের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম যতটুক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দরকার, তার বিন্দুমাত্র নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়,কথাটাও এক্কেবার প্রযোজ্য নয় এদের ক্ষেত্রে। কারণ, দক্ষিণ কসবার প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা ও তাঁর সন্তানের ঘরে নুনেরই আকাল, আর পান্তা ভাত তো দূরের স্বপ্ন।
ওরা মানে, দুই প্রতিবন্ধী, মা সুখদা দাস (৭০) ও সন্তান গনেশ দাস (৩২) একসাথে বাস করেন রায়গঞ্জের দেবীনগরের দক্ষিণ কসবার এক পুকুর পাড়ে।
ঘর বলতে টিনের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। আশে আশে শুধু ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড় না থাকলে জোর হাওয়ায় উড়ে চলে যেত টিনের বেড়া। সেই ঝুপড়ির মধ্যেই এই ‘নেই রাজ্যের সংসার’। বাসন নেই, জামা নেই, কাপড় নেই। নেই দুমুঠো গরম ভাতের গন্ধ। প্রতিদিন সকালে উঠে দুই প্রতিবন্ধী মা ও ছেলে ভাবতে শুরু করেন,
সারাটা দিন চলবে কি করে। ঘরে খাবারের অভাব, অথচ শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রকম অসুখ। ফলে ওষুধ কিনতেই প্রচুর পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন।
বৃদ্ধা সুখদা দাস কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘১৯৮৭ সালের বন্যায় পাড়াহরিপুরের বাড়ি ভেসে যায়। তখন থেকে মালিক হরিপদ সাহার বানিয়ে দেওয়া ঘরে থাকি। ২০১০ সালে স্বামী চৈতন্য দাস মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা প্রায় অনাহারে আছি। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি রাজগ্রামে। এখন বার্ধক্য ভাতার এক হাজার টাকা করে প্রতিমাসে পাই।
কিন্তু এই টাকায় দুজনের খাবার যোগাড় করা তো দূরে থাক, লজ্জা নিবারণের কাপড় জামা কেনাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আজকের যুগে এক হাজার টাকায় কি আর বেঁচে থাকা যায়’, কাঁদতে কাঁদতে বলেন বৃদ্ধা।
ঘরের এক কোণে কিছুটা ডাল, কিছুটা চাল পড়ে আছে। সেটা সেদ্ধ করে খেয়েই কোনমতে আজকের দিন যাবে এই দুই প্রতিবন্ধী মা ও সন্তানের। সন্তান গনেশ কথায় কথায় জানায়, বছর দুয়েক আগে এই প্রতিবন্ধী শরীরে নিয়েও কাজ করতে যেতাম। কিন্তু মা অসুস্থ থাকায়, এখন আর কাজে যেতে পারিনা।
বয়স জনিত কারণে মা মাঝে মধ্যে পড়ে যায়। তাই আর কাজে যাওয়া হয় না। ফলে ঘরে অভাব-অনটন সৃষ্টি হয়েছে। সে বলে, ‘দুপুরে আগে তাও মাঝে মধ্যে মা এপাড়া, ওপাড়া ভিক্ষা করতে যেত।
কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে সেই ভিক্ষার চাল আনা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। ভিক্ষার চাল বা দু-এক টাকা পেলে হয়তো নুন, তেল কিনে, সেদ্ধ ভাত খেতে পারতাম। তাই এক ভয়ঙ্কর অনটনের মুখোমুখি হয়েছি।’ কিভাবে কাটবে দিন, এই আশঙ্কায় দিন থেকে রাত পার হয়ে যায় এই দুই প্রতিবন্ধী মানুষের।
রায়গঞ্জের কসবা পেট্রলপাম্পের সামনে দক্ষিণ কসবায় একটি ঘর করে তাকে দিয়েছিল সেই সময় তার মালিক হরিপদ সাহা। হরিপদ বাবু মারা যাওয়ার পরে, তার সন্তান গত লকডাউনের সময় নানা রকম খাদ্য খাবারের যোগান দিলেও এ বছর তিনি পড়েছেন বিপাকে।
আজই গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে চার কেজি চাল, ৫০০ গ্রাম ডাল, কিছুটা তেল ও লবণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এই চাল ডাল দিয়ে চলে যাবে কয়েকটা দিন।
যদিও ১০ নং মাড়াইকুড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কমল দেবশর্মা বিষয়টি জানেন স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘পঞ্চায়েত থেকে ওই সুখদা দাসের বার্ধক্য ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গনেশ দাসের প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট তৈরি করার জন্য ওদের বলা হয়েছিল।
কিন্তু ৫০শতাংশের কম প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে, ওরা প্রতিবন্ধী ভাতার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। তবুও আমি প্রধানের নিজস্ব ফান্ড থেকে ওদের নানা রকম ভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি।’
সুখদা দাসের বাড়ির পেছনের জাতীয় সড়ক দিয়ে বড় বড় গাড়িতে বহু মানুষ এক স্থান থেকে অন্যত্র পাড়ি দিলেও, এই দুই প্রতিবন্ধী মা ও সন্তানের জীবন থমকে গেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও অভাবে। পূর্ব দিকে নতুন কোনো আশার সূর্য ওঠে কি না, সেদিকেই তাকিয়ে থাকে অভাবী মায়ের ব্যাকুল চোখ।