প্রবাসীদের ক;ষ্ট কেউ বোঝে না, সবাই খোঁজে টাকা

আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা প্রায়ই অভি;যোগ করে বলে তুমি বিমানে চড়ে প্রবাসে গিয়ে বেঈমান হয়ে গেছ। কতদিন হয়ে গেল কল দেও না। নাকি অনেক টাকার মালিক হয়েছ। টাকা চাইব এই ভ;য়ে কল দেও না? ভয়ের কিছু নেই ধার নেব না।

উত্তরে তাদের কিছু বলি না, বলতেও পারি না। কারণ তাদের বললেও বুঝবে না। আমি জানি তাদের অভি;যোগ সত্য তাই নীরবে কথার তীরে বিদ্ধ হতে থাকি। পৃথিবীতে কথার তীরের মতো বিষাক্ত বুঝি কিছুই নেই। নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকি যে কারো সাথে কথা বলার সুযোগ হয় না। আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না, সবাই খোঁজে টাকা। রাতের শেষ প্রহরে কোমলতা নেমে আছে পৃথিবীর বুকে। তখন পৃথিবীটা খুব শান্ত ও সুন্দর লাগে। চোর, সাধু রাত-জাগা মানুষগুলো শেষ প্রহরে ঘুমকে আলিঙ্গন করে নেয়।

এই সময়টায় থেমে যায় মদের বারগুলোর উল্লাস ধ্বনি। মাতালরা যে যেখানে পারে গড়াগড়ি করে নেয়। রাত জেগে ময়লার স্তূত থেকে খাবার অন্বেষণকারী কুকুরগুলোও ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ে। প্রকৃতি ঘুমন্ত নগরীর ওপর বিছিয়ে দেয়, এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের ওড়না।

আর আমি সেই কোমলতা, নৈসর্গিক ওড়না ভেঙে জেগে উঠি, ঘুম ঘুম চোখে ছুটে চলি জীবিকার সন্ধানে। কোম্পানির গাড়ি অফিসের গেটে পৌঁছালেও ঘুম আমাকে ছাড়ে না। তাই যেখানে সুযোগ পাই, সেখানেই ঘুমিয়ে নেই খানিকটা সময়। অনেকে তো রাস্তার পাশে গাছতলায়ও ঘুমিয়ে পড়ে। ডিউটি সাড়ে সাতটায় কিন্তু কোম্পানির গাড়ি ছয়টার আগেই অফিসে এনে পৌঁছে দেয়। তাই সাতটা দশ মিনিট পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেই।

কাজের পূর্বে সুপারভাইজারের ব্রিফিং শেষ হলেই শুরু হয় সংগ্রাম। এই সংগ্রাম নিজে বেঁচে থাকা এবং পরিবারের সবার মুখে হাঁসি ফোঁটানোর সংগ্রাম। দুপুরের খাবার সে’তো কতদিন হয়ে গেল প্লেটে খাইনি। কোনো এক সময় তো সুন্দর নকশা করা প্লেট ছাড়া খেতেই পারতাম না। আর এখন একধরনের কাগজের উপর (মাখান পেপার) খেয়ে নেই।

কিন্তু আফসোস কাগজের উপর থেকে ডালটা চুমুক দিয়ে খেতে পারি না। অথচ কোনো এক সময় খাবার শেষে চুমুক দিয়ে ডাল না খেলে আমার খাবার খেয়ে তৃপ্তিই হত না। খাবার শেষে আমার ব্রিফিং আবার কাজ এভাবেই চলে বিকেল অবধি। বিকেলে হালকা চা, কফি কিংবা একটা বিস্কুট খেয়ে জিড়িয়ে নেই। কখনো বাবার সঙ্গে কিংবা ভাইদের সাথে চলে কিছুটা আলাপচারিতা।

আমাদের ডিউটি চলাকালীন সাধারণ কর্মীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। আমি মোবাইল বহন করতে পারলেও যত্রতত্র ব্যবহার করতে পারি না। কোম্পানির প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করা দৃষ্টিকটূ। তাই মোবাইলটা সযত্নে পকেটেই পড়ে থাকে।

দিনের কাজ সমাপ্তি আবারও গেটের বাহিরে কোম্পানির পরিবহনের জন্য অপেক্ষা। হর্ন দিয়ে গাড়ির আগমন, হুড়াহুড়ি করে গাড়িতে উঠি। গাড়িতে বসে দম বন্ধ হবার উপক্রম সহকর্মী আর আমার গায়ের ঘাম শুকিয়ে বিদঘুটে এক গন্ধ বের হয়। এই গন্ধ শুকতে শুকতেই বাসায় ফিরি।

প্রথম প্রথম ঘামের গন্ধে বমি আসত, অস্বস্তি অনুভব করতাম। কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মানুষকে নাকি যে কোনো জায়গায় অনেকদিন রাখলে সে জায়গার মায়া জন্মে যায়, তাই সে যে কোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আচ্ছা নরকেও যদি অনেকদিন রাখা হয় একটা সময় কি আমি সেখানে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাব? সে জায়গার প্রতি মায়া জন্মে যাবে?

বাসায় ফিরে দিনের ব্যবহৃত কাপড় ধৌত করে গোসল করার পর রাত নয়টা বেজে যায়। আর তখন শুরু হয় রান্নার কাজ। রান্না শেষ করে খেতে খেতে রাত প্রায় এগারটা। সারাদিন প্লান ছিল অনেকের সাথে কথা বলব কিন্তু খাবার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই ক্লান্তিতে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে। কারো সাথে কথা হয় না, কারো কাছে নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করা হয় না।

এভাবেই চলছে দিন, মাস আর বছর। কিন্তু কাউকে এই ব্যস্ততার কথা বোঝাতে পারি না। সবাই মনে করে আমি সারাদিন অফিসে বসে থাকি। নিজেকে অন্যের কাছে ব্যাখা করতে ইচ্ছে করে না। তাই কাউকে কিছু বলা হয় না। কিছু কিছু কষ্ট থাক না একান্ত নিজের। প্রবাসীদের কিছু কিছু কষ্ট একান্ত নিজের।