লকডাউনে খদ্দের নেই,কঠিন অবস্থায় যৌ’নকর্মীরা!

পটুয়াখালীর পুরাতন হাসপাতাল রোড। যেটি যৌনপল্লী হিসেবেই পরিচিত। করোনার আগেও সেখানে সারা দিন-রাত খদ্দেরদের আনাগোনা চলতেই থাকত। কিন্তু এখন পটুয়াখালীর ওই এলাকাটি একেবারে শুনশান, নিস্তব্ধ। লকডাউনের কারণে রাস্তায় কোনো

নারী যৌনকর্মী এখন খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকছেন না। তারা এখন অপেক্ষা করছেন, কখন কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের খাবার বিলি করতে আসবেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবার পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক যৌনপল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহয়তা হিসেবে খাবার বিতরণ করেছেন। দিয়েছেন পল্লীর অন্তত ১৫টি শিশুকে ঈদের পোশাক।

ওই এলাকাতেই যৌনকর্মী হিসেবে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন তানিয়া বেগম নামের এক নারী। তিনি যৌনকর্মীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শক্তি নারী সংঘ’র সহ-সভানেত্রী। মুঠোফোনে বলছিলেন,আমরা যে কী অবস্থায় পড়েছি, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।

লকডাউনের পর থেকে একটাও খদ্দের নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের আসার উপায়ই তো নেই। তাই রোজগার নেই।আরেক যৌনকর্মী সাথী বললেন, তার দুই ছেলে। আছে এক পুত্রবধূ, তার ঘরেও একটি সন্তান। এত বড় সংসার নিয়ে কী করে বাঁচব কে জানে! এই সংকট শুধু আমার না, ১৪০ জন মেয়ের একই অবস্থা।

শক্তি নারী সংঘের সহ-সভানেত্রী তানিয়া বেগম বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সরকারি নির্দেশনা আছে। কিন্তু আমাদের পেশাটা এমনই, যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভবই নয়।কিন্তু তার মধ্যেও করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা চেষ্টা করেছেন কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে।

পটুয়াখালী পৌরসভা লকডাউনের পর পল্লীতে খদ্দেরের আসা-যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সেই থেকে আর খদ্দেরের দেখা নেই। আমরাও পল্লী ছেড়ে বাইরে বের হচ্ছি না।শক্তি নারী সংঘের সাধারণ সম্পাদিকা সন্ধ্যা বেগম বলছিলেন, ‘করোনা যখন থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকেই আমরা খদ্দের এলেই তাকে সাবান দিয়ে হাত ধুইয়ে তার পরেই ঘরে ঢুকাচ্ছিলাম। এমনকি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবারও হাত ধুয়ে তারপর বের হতে হচ্ছে।

কোনো কর্মীর যদি শরীর খারাপ থাকে, জ্বর, সর্দি-কাশি হয়, তাহলে তার ঘরে প্রবেশ নিষেধ ছিল। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘লাইট হাউস’র কর্মীরা আমাদের শারীরিক অবস্থার নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছেন। তার পরেও লকডাউনের কারণে আর খদ্দের আসছে না।

সংগঠনের সভানেত্রী ঝুমুর বেগম মুঠোফোনে বলেন, লকডাউনের কারণে যৌনপল্লীতে খদ্দের আসছেন না। তাই যৌনকর্মীদের রোজগার শুন্যে নেমে এসেছে। যৌনকর্মীরা নিজেরা তো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেনই। এমনকি তাদের

বাবা-মায়ের কাছেও খরচ পাঠাতে পারছেন না। তাই সেই সব পরিবারগুলোও আরো বিপদের মুখে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মাঝে মধ্যে কিছু সংগঠন খাবার দিয়ে যাচ্ছে। তা দিয়ে বড়জোড় দুই দিন চলে যাচ্ছে। আবার সেই একবেলা, কখনো আধপেটে খেয়ে থাকতে হচ্ছে।

সভানেত্রী ঝুমুর বেগম আরো বলেন, তাদের সংগঠনে যৌনকর্মী (সদস্য) ১৪০ জন। বৃদ্ধা আর শিশু রয়েছে ১১০ জন। এদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু। বৃদ্ধদের মধ্যে ১৬ জন পল্লীর মধ্যে দোকান দিয়েছেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে খদ্দের আসছে না,

তাই বিকিকিনিও বন্ধ রয়েছে। দেড় বছর আগে তিনি সভানেত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তখন সংগঠনে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিল। করোনা শুরুর পর যৌনকর্মীদের গচ্ছিত সেই টাকা তারা নিয়ে গেছেন। এমনকি যৌনকর্মীরা জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে, যা আদৌ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, লকডাউনে ঝুঁকিপূর্ণ নারীরা খাদ্য সংকটে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে ১৫০ জন ঝুঁকিপূর্ণ নারীকে পাঁচ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ লিটার তেল, আধা কেজি করে ডাল,

মুড়ি আর ছোলা বুট পৌঁছে দিয়েছি। একই সঙ্গে পল্লীর ১৫ শিশুকে ঈদের পোশাক দেওয়া হয়েছে। পল্লীতে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের এই সহয়তা তিনি নিজেই তুলে দেন। পল্লীর অনুষ্ঠানে পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, পটুয়াখালী প্রেস ক্লাব সভাপতি স্বপন ব্যানার্জী উপস্থিত ছিলেন।